সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫,
১৪ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: নীলক্ষেত মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন      আদালতে আত্মসমর্পণে জামিন পেলেন পরীমণি      ঋণ বিনিয়োগে করুণ হাল, রফতানি-রেমিট্যান্সে স্বস্তি       ৭ কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাবি উপাচার্যের জরুরি সভা আজ      পবিত্র শবে মেরাজ আজ      ঢাকা শহর অবরোধের ঘোষণা সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের      ৪ ঘন্টা পর থামলো ঢাবি ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ      
জীবনানন্দ
কবরের পাশে দাঁড়িয়ে
রফিকুজ্জামান রুমান
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫, ৭:০৪ পিএম আপডেট: ২৪.০১.২০২৫ ৮:১২ পিএম  (ভিজিটর : ১১৩)
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

জোহরের নামাজ শেষ হয়েছে সেই দেড়টায়। এখন দুইটার বেশি বাজে। ছেলেকে এখনো আসতে না দেখে মা উঠোনে নেমে কবরস্থানের দিকে তাকালেন। ছেলে রোদের মধ্যে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে। শীতের রোদ বলে হয়ত সহনীয়। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের দুগাল ভরে গড়িয়ে পড়া অশ্রু রোদের কারণে চিকচিক করছে বলেই মা কান্নাটা টের পেলেন।

কবর জিয়ারত করবার জন্য কবরকে সামনে রাখা শর্ত নয়। সে হিসেবে ঢাকায় বসেও সে কবর জিয়ারত করে। কিন্তু জিয়ারতের উদ্দেশ্য যদি মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া কামনার পাশাপাশি জিয়ারতকারীর মধ্যে মৃত্যুর একটি উপলব্ধিবোধ জাগ্রত করিয়ে দেওয়াও হয়, তাহলে কবর সামনে থাকা জরুরি।

বাবার কবর সাধারণত সে সকাল বেলাই জিয়ারত করে। আজকে অনেক কুয়াশা থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। ঢাকায় চলে যাবে বলে দুপুরে কবর জিয়ারত করতে লাগল। কিন্তু অদ্ভুত এক উপলব্ধি তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। জিয়ারতে যে দোয়াগুলো পড়া হয় সেগুলো পড়া শেষ, তবুও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। মোনাজাত করার কথাও সে ভুলে গেল। নীল পলিথিন দিয়ে ঢাকা কবরের দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ। ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে।

আব্বা মারা গেলেন ছয় মাস হলো। এই ছয় মাসে একবারই মাত্র বাড়ি এসেছি আমি, চল্লিশতম দিনে। অনেক চেষ্টা করেও ‘চল্লিশা’ উদযাপন ঠেকাতে যখন ব্যর্থ হলাম, তখন এই প্রবোধ দিয়ে আমাকে বাড়ি নেওয়া হলো যে, কোনো অনুষ্ঠান হবে না; শুধু মসজিদে দোয়া পড়িয়ে সামান্য কিছু আপ্যায়ন করানো হবে। কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন পরে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করতে হবে, অনেক মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে হবে এরকম একটি উৎসবের কী যৌক্তিকতা আছে, তা আমি বুঝতে না পেরে ফ্যামিলির বড়োদের কাছে যখন জিজ্ঞেস করলাম, তারাও যুক্তির কোনো কথা শোনাতে পারল না। তারপরও করতে হবে। মানুষ মারা যাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের কোনো বিষয় নয়। তাহলে কেন এই অনুষ্ঠান? দোয়া যদি করতেই হয় তাহলে আপন সন্তানদের দোয়ার সামনে আর কার দোয়া কবুল হতে পারে? সন্তান চোখের পানি ফেলে পিতামাতার জন্য দোয়া করলে তা বিফলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বড়ো একটি আয়োজনে যে দোয়া অনুষ্ঠান করা হয়, সেখানে কারো চোখে আমি পানি দেখিনি। তাদের সেই আবেগ থাকারও কথা নয়। এ ধরণের অনুষ্ঠান যত না দোয়ার তার চেয়েও বেশি ‘সামাজিকতার’।

সেই অনুষ্ঠানের পরে আমি আর বাড়ি আসিনি। এর বড়ো একটি কারণ হলো বাড়িতে আসলে আব্বার কথা বেশি মনে পড়ে। ঘরে আব্বা নেই এটি সয়ে যাওয়া যে কত কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। অত্যন্ত কর্মঠ ছিলেন আব্বা। কোনোদিন তাকে অলস হতে দেখিনি। সারাক্ষণ কাজের মধ্যে ছিলেন বলেই ঘরের প্রতিটি জায়গায় তাঁর ছোঁয়া উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। আব্বার আব্বা অর্থাৎ আমার দাদা মারা গিয়েছিলেন আব্বা যখন এসএসসিতে পড়তেন তখন। তাই জীবনের শুরু থেকেই জীবনকে বুঝতে শিখেছিলেন। বোধ করি এ কারণেই অবসরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠেনি কখনোই।

বাড়িতে না আসার আর একটি কারণ এই কবর, আমি এখন যার সামনে দাঁড়িয়ে। কবর এমনিতেই একটা ভীতির কারণ, তার উপরে এটি আব্বার কবর হওয়ায় ভয়ের সাথে আছে কষ্টও। এই ভয় আর কষ্ট একত্রিত হয়ে যে একটি ভয়ংকর উপলব্ধি তৈরি করে তা সহজেই বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। যতবারই কবরের দিকে তাকাই, ততবারই আব্বার চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর তখনই স্মৃতিরা এসে ভিড় জমায়, শুরু হয় কষ্ট। শহরের কনক্রিট জীবনে স্বভাবতই ব্যস্ত থাকতে হয় বিভিন্ন কাজে। কবর দেখতে হয় না। তাই কষ্টকর উপলব্ধি থেকে বেঁচে যাই। বাড়িতে আসলে কবর দেখতেই হয়। কবর দেখার এই কষ্ট থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্যই বাড়ি যেতে ইচ্ছা হয় না।

মানুষের দুঃখ যতই বড়ো হোক, কষ্ট যতই সীমাহীন হোক, সময়ের কাছে তার হিসেব নেই। মানুষ সময়ের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত, কিন্তু মানুষের হিসেব মেলানোর দায় সময়ের নেই। তার সমস্ত দায় ছুটে চলার দিকে। দুঃখ এবং দুর্দশা, বিপদ এবং বিপর্যয়, সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা কতই না মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে নিত্য সহযাত্রী হিসেবে। কিন্তু কারো দিকে ফিরে তাকানোর সময় সময়ের নেই। সময়ের কাজ ঘটনা ঘটানো; ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য সে অপেক্ষা করে না।

সময়ের গতিশীলতার কারণেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইরাকেও ঈদের চাঁদ ওঠে। ইরাকের মানুষ সেই চাঁদকে মার্কিন কামানের গোলা মনে করে ভুল করছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব সময়ের নয়। আমাদের বাড়িতেও এবারে ঈদের চাঁদ উঠেছিল। সবকিছুই ছিল ঠিক। কিন্তু গতবারের ঈদে আমাদের মাঝে আব্বা ছিলেন সরব, এবার তিনি নীরব। একটি মাত্র মাটির দেয়াল গতবারের সাথে এবারের যে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে, তাকে ভাঙবার কিংবা অতিক্রম করবার শক্তি বা সাধ্য কোনোটিই আমাদের নেই। মাঝে মধ্যেই মনে হয়েছেু এবারে ঈদ নামক ব্যাপারটি না আসত! কিন্তু এখানেই সময়ের কাছে মানুষের পরাজয়।

সময়ের কাছে পরাজিত হলেও পরিস্থিতির কাছে পরাজিত হতে চাইনি। তাই আম্মা বাড়িতে থাকার পরেও ঈদে বাড়ি যাইনি। বাড়ি গেলে গত ঈদের স্মৃতিগুলো তাড়া করত। ঈদের দিন সকালে ফোনে আম্মা আর ছোটো আপুর যে কান্না টের পেয়েছি, তাতেই বাড়ির পরিস্থিতিটা বুঝা যাচ্ছিল। আমি জানিু আম্মাকে শান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হলেও আমার বাড়ি যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু কাঁদার যে কষ্ট, কাঁদতে না পারার কষ্ট বোধ করি তার চেয়েও বেশি!

ঈদের আমেজ যখন শেষ তখন আম্মার সাথে দেখা করতে বাড়িতে গেলাম। প্রতিদিনের মতো আজও কবর জিয়ারত করতে লাগলাম, দুপুরে-জোহরের নামাজের পর।

উঠোনে দাঁড়িয়ে মা ছেলেকে দেখছেন অনেকক্ষণ ধরে। জিয়ারত শেষ হচ্ছে না, শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে বিরতিহীন। মায়ের চোখেও পানি এসে গেল। আস্তে আস্তে ছেলের কাছাকাছি চলে এলেন। পেছনে এসে দাঁড়ালেন বটে, কিন্তু ছেলে টের পেল কিনা বুঝতে পারলেন না।

ছেলে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে কথা বলে চলেছে তার আব্বার সাথে- আপনি শুয়ে আছেন মাটির নিচে, ঠিক উপরেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে আপনি কেমন আছেন! যদিও জানি এর উত্তর কোনোদিনও মিলবে না। মাঝখানে একটি মাত্র মাটির দেয়াল, অথচ কত দূরে আপনি! মৃত্যু যে কত নিষ্ঠুর একটি বাস্তবতা তা আগে বুঝতে পারিনি। এটি আসুক কেউ চায় না; অথচ এটি আসবেই। ঠিক একদিন আগে ঢাকা থেকে বাড়ি আসলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠলেন। ফজরের নামাজও পড়লেন। সারাদিনে কী কী করবেন তার পরিকল্পনাও হয়ত করেছিলেন, কিন্তু...

আপনার কবর একটি নীল পলিথিন দিয়ে ঢাকা। পলিথিনের নিচে এবং উপরে কিছু পোকা খেলা করছে। পিঁপড়াও আছে অনেকগুলো। সত্যি আব্বা, আজ আপনাকে এবং সেই সূত্রে সব মানুষকে পিঁপড়ার চেয়েও অসহায় মনে হয়। পিঁপড়াকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য, ওর নিজের কোনো দায়িত্ব নেই। জন্ম লাভের মাধ্যমে শুরু, মৃত্যুই ওর শেষ কথা। কিন্তু মানুষ! মৃত্যু তার জন্য একটি নতুন জীবনের প্রবেশদ্বার। মৃত্যুর আগের জীবনের শেষ আছে কিন্তু পরের জীবন অন্তহীন।

মানুষকে যে বিবেক এবং বিবেচনাবোধ দেওয়া হয়েছে, স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতেই তার একটি হিসেব আল্লাহ নেবেন। আপনি আজ ‘হিসেবের জগতে’ চলে গেছেন। সেটি এমন এক জগত যেখানে শুধু হিসেব জমা দেওয়ার কাজটিই করা যায়; হিসেবের খাতায় নতুন করে কিছু লেখা যায় না। আপনার সামনে ৬৫ বছরের জীবনের হিসেব। আল্লাহ আপনার হিসেবকে সহজ করুন।

আব্বা, আপনার হিসেবের খাতা পরিবর্তন করবার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি, হিসেবের খাতার পৃষ্ঠা যাদের এখনো শেষ হয়ে যায়নি, তারা কেন সচেতন হতে পারছি না? আপনার মতো অসংখ্য মানুষকে প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করতে দেখছি, কিন্তু নিজেদের মৃত্যুর কথা একবারও কেন ভাবছি না? সন্তানদেরকে আপনি অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের বড়ো করার জন্য নিজের অনেক স্বার্থকে আপনি বিসর্জন দিয়েছেন। একবার ঢাকা থেকে বাড়ি আসতে পথে আমার দেরি হচ্ছিল। আপনি শীতের মধ্যে অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন গভীর উদ্বেগ নিয়ে। ছোটো আপুর জ্বর হয়েছিল একবার। আপনি অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারেননি। এত ভালবাসার সন্তানদেরকে ছেড়ে আপনাকে যেতেই হলো। দুটি বাড়ি ছিল আপনার। কিন্তু আজ আপনি শুয়ে আছেন ছোট্ট একটি মাটির ঘরে।

আপনার আব্বার কবরের পাশেই আপনার কবর। আপনার পাশের কবরটি কি আমার হবে না?

মা ছেলের পিঠে আলতো করে হাত রাখলেন। পেছনে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরল সে। কান্না-জড়িত কণ্ঠেই বলল আম্মা, এত মৃত্যু কেন আমাদের জাগিয়ে তোলে না, এত কবর কেন আমাদের বিনয়ী করে না?

কেকে/এএম



মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

গজারিয়ায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হামলায় আহত ১
নীলক্ষেত মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন
আদালতে আত্মসমর্পণে জামিন পেলেন পরীমণি
ঋণ বিনিয়োগে করুণ হাল, রফতানি-রেমিট্যান্সে স্বস্তি
কার্নিসে ঝুলে থাকা শিক্ষার্থীকে গুলি, সেই পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতার

সর্বাধিক পঠিত

সিরাজগঞ্জে বাস চাপায় শিক্ষকসহ নিহত ২
সমন্বয়কদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ৩৩ জনের নামে মামলা
নীলক্ষেত নিউমার্কেট এলাকা রণক্ষেত্র, আহত ২৩
ঢাবি-সাত কলেজ সংঘর্ষের নেপথ্যে যত ঘটনা!
সংঘর্ষের দায়ভার হাসিনা ও আরেফিন সিদ্দিকীর: ছাত্রদল সেক্রেটারি
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝