সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটির এবং বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এ সংগঠনগুলো শীর্ষ নেতাদের দেওয়া বক্তব্য ও পাল্টা-বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া প্রভাব ফেলছে জনমনে। এমনকি হাসিনাবিরোধী এ দলগুলোর নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরে মতানৈক্যে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে আওয়ামী লীগ। অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উসকে দিয়ে দলটি করছে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দলের নেতাকর্মীরা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা রাখছে অব্যাহত। বিশেষ করে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ফেসবুক ও সংগঠনের কয়েকটি পেজ থেকে একের পর এক অপতথ্য প্রকাশ করতে থাকেন। ফলে এসব অপপ্রচারে অনেকটা বিব্রত হতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাসহ বিএনপি ও ছাত্রনেতাদের।
সম্প্রতি এক আলোচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিকে মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যেও পাল্টা জবাব দিয়েছেন সরকারের দুই উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টে লিখেন, বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। ১/১১-এর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ১/১১ সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে। তার পোস্টে সেনানীবাসের বৈঠকসহ মির্জা ফখরুলের বক্তব্যেও কড়া জবাব দেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারাও একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করতে থাকেন। এতে বিএনপি ও সমন্বয়দের মধ্যে শুরু হয় তুমুল উত্তেজনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠন আব্দুল হান্নান মাসুদ তার ফেসবুকে লিখেন ‘তারা সেদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূস যাতে প্রধান উপদেষ্টা না হতে পারেন, তার সর্বোচ্চ চেষ্টাও করেছিলেন।’ যদিও তার এ পোস্ট কাকে ইঙ্গিত করে দিয়েছেন, সেটা স্পষ্ট করেননি। আরেক সমন্বয়ক রিফাত রশিদ ফেসবুকে লিখেন ‘২৮ অক্টোবর ২০২৩-এর কথা স্মরণ করাইতে চাচ্ছি বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাদের। ভোটের দাবিতে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দল-মতের লোকজনের পাশাপাশি গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতিতে ঢাকার রাজপথ কাঁপছিল। ঠিক তখনই পুলিশ মিছিলের দিকে তাক করে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়ে, কোথাও কোথাও রাবার বুলেট। আর এতেই বানের জলের মতো ভেসে যায় বিএনপির নেতৃত্বে ডাকা লাখ লাখ মানুষের জনস্রোত।’
‘সেদিন পল্টনে উপস্থিত মানুষের অনেকেই তো জুলাইয়ে শহিদ হয়েছেন। বিএনপি-ছাত্রদল নিজেই তাদের দলীয় শহিদদের লিস্ট প্রকাশ করে (সেই লিস্ট যে কি পরিমাণ ত্রুটিযুক্ত ও মিথ্যায় ভরপুর তা স্পষ্ট)। এখন বিএনপি নেতাদের কাছে প্রশ্ন হইলো, আপনাদের দলের নেতাকর্মীরা আপনাদের নেতাদের ডাকা সমাবেশে টিয়ারশেল খেয়ে পালিয়ে যায়, কিন্তু আসিফ মাহমুদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কিংবা নাহিদ ইসলামের ডাকা ১ দফার বাস্তবায়নে কেন বুকে লাইভ বুলেট খাওয়ার জন্য বুক পেতে দিচ্ছিল? এর কারণ লিডারশিপ। আপনার দলের নেতাকর্মীরা জানে আপনারা আপোষকামী। আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়েছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিজের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করে শেল্টার নিশ্চিত করেছেন। তৃণমূলের কর্মীরা যখন জেলে পচে মরেছে, বছরের পর বছর মায়ের মুখ দেখতে পারেনি ছেলেটা কারণ ছাত্রদল করা ছেলেটার গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ। মায়ের জানাজায় শরিক হতে হয়েছিল হাত-পায় ডাণ্ডাবেড়ি পরে, কেউ সেই সুযোগটাও পায়নি। কিন্তু আপনারা ঠিকই দিনগুলো গুলশান-বনানী-বারিধারার অভিজাত বিল্ডিং এ কাটিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি এ পোস্টে বিএপিকে আরো দীর্ঘ সমালোচনা করেন।
এর আগে আদর্শিক বিভাজন থেকে সবাইকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘জিয়াবাদ বলুন, মুজিববাদ বলুন আমরা কোনো বাদ বাংলাদেশে চাই না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রধান জায়গায় থাকবে জনগণ। জনগণের পক্ষেই আমরা লড়াই করতে চাই।’
তার এ বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক এ বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, যে জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, যে জিয়া বাংলাদেশকে মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত দিয়েছেন, যেই জিয়া সার্ক গঠন করেছেন, যেই জিয়া খাল খনন করে কৃষকদের সেচের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যে জিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বসে সমস্যা সমাধান করেছেন; সেই জিয়াবাদ নিয়ে দয়া করে কোনো মন্তব্য করবেন না।
স্বাধীনতা পেয়ে অনেকে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছেন বলে দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, কেউ, কেউ বলছে বিএনপি আবারও ১/১১ (ওয়ান-ইলেভেন) আনার পাঁয়তারা করছে। ১/১১-এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার বিএনপির চেয়ে কেউ হয়নি। গতকাল শুক্রবার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের নিচতলায় আরাফাত রহমান কোকোর দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন।
এ ছাড়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘শুনতে পাচ্ছি সরকারের ভেতর থেকে বিভিন্ন লোক রাজনৈতিক দল গঠন করার চেষ্টা করছে। উপদেষ্টারা দল গঠন করলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণ প্রশ্ন করতেই পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেখছি সরকার গঠনের পরে কোনো কোনো উপদেষ্টা বিএনপির প্রতি অত্যন্ত বিরূপ ধারণা দিয়ে কেউ প্রকাশ্যে, কেউ অপ্রকাশে কথা বলছেন।’ গতকাল বনানী কবরস্থানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ১০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার কবর জিয়ারত শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী নেতাদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বিশ্লেষকরা মনে করছেন ‘এই দ্বন্দ্বের ফলে সরকারবিরোধী জোট দুর্বল হচ্ছে, যা আওয়ামী লীগের জন্য একটি সুবিধা। তারা মনে করেন ‘যদি বিরোধী শক্তি নিজেদের মধ্যে লড়াই করে, তবে আওয়ামী লীগের জন্য পুনর্বাসন আরো সহজ হবে। হাসিনা বিরোধীদের বিরোধে সবচেয়ে বড় পায়দা নিবে পতিত এ দলটি।’
কেকে/এমএস