বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে। তবে প্রবাসী আয় ও রফতানির গতি অব্যাহত থাকায় কিছুটা স্বস্তি মিলছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ শতাংশের বেশি। আর ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আসার পর চলতি মাসেও তা ছাড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭ শতাংশের বেশি। একইভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ অর্থবছরের ত্রৈমাসিকে ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২৫ দিনে এলো ২০৪৪৭ কোটি টাকার প্রবাসী আয়নতুন বছরের প্রথম মাসের (জানুয়ারি) ২৫ দিনে ১৬৭ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ২০ হাজার ৪৪৭ কোটি ২ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন আসছে প্রায় ৮১৮ কোটি টাকার বেশি। এভাবে এলে চলতি মাসেও রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য উঠে এসেছে। এর আগে সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩১ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার বেশি।
একক মাস হিসাবে আগে কখনোই এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। এর আগে করোনাকালীন ২০২০ সালের জুলাই ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বরে) এক হাজার ৩৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যা ছিল গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বেশি। গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৮০ কোটি ডলার।
ছয় মাসে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশজুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রফতানি কমে গেলেও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্র জটিলতা কমে যাওয়ায় রফতানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসায় বেড়েছে বাংলাদেশের রফতানি।
জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রফতানিতে কিছুটা ধস নামে। তবে ধীরে ধীরে এ ধস থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। বাড়তে শুরু করেছে পণ্য রফতানি। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বরে যথাক্রমে ৪১৩ ও ৪১১ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আর ডিসেম্বরে রফতানি বেড়ে ৪৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
চার মাস টানা ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের বেশি পণ্য বিদেশে রফতানি হয়েছে। ফলে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বরে ২ হাজার ৪৬২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। গত বছর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ২ হাজার ১৮৮ কোটি ডলারের রফতানি হয়। বাণিজ্য বাড়াতে এখন থেকেই নতুন বাজার খোঁজারও তাগিদ দেন সংশ্লিষ্টরা।
ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ৬৭.১১ শতাংশডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে ১.১ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়ার পরও চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬৭.১১ শতাংশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ২.২৯৮ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬.৯৮৯ বিলিয়ন ডলার।
বাজেট সহায়তার ঋণ চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থছাড় হয়ে যায়। এরপরও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের অর্থছাড় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, এসময় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৩.৫৩২ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪.০৬ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমলেও আগের নেওয়া ঋণের কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ বিভিন্ন ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছে ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাংলাদেশ পরিশোধ করেছিল ১.৫৬৭ বিলিয়ন ডলার।ঋণ পরিশোধ বাড়ার ব্যাখ্যা দিয়ে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বিগত সরকারের সময় নেওয়া অনেক বড় প্রকল্পের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে। আবার বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহারের কারণে সুদ পরিশোধও বেড়েছে।
তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ ১১ বছরে সর্বনিম্ন দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) খরা কাটছে না, উল্টো পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৭১ শতাংশ কম।
বাংলাদেশে এক প্রান্তিকে এফডিআই এতটা কমে যাওয়ার ঘটনা সম্প্রতি আর ঘটেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, এক প্রান্তিকে এত কম এফডিআই গত ১১ বছরে কখনো আসেনি। ২০১৪ সাল থেকে প্রান্তিকভিত্তিক এফডিআইয়ের হিসাব প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগে ষাণ্মাসিক পরিসংখ্যান দেওয়া হতো। ফলে তার আগের বছরগুলোর সঙ্গে গত জুলাই-সেপ্টেম্বরের এফডিআইয়ের তুলনা করা যায়নি।
এফডিআই নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট নতুন বিনিয়োগ বা ইকুইটি এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। তার আগের প্রান্তিকেও (এপ্রিল-জুন) নতুন বিনিয়োগ এসেছিল প্রায় তিন গুণ-২১ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট নিট এফডিআইয়ের ৭ কোটি ২৯ লাখ ডলার পুনর্বিনিয়োগকৃত আয় থেকে আসে। ফলে নতুন ও পুনর্বিনিয়োগ মিলে এসেছে মোট ১৪ কোটি ৯৬ লাখ। তা থেকে আন্তঃকোম্পানি ঋণ ৪ কোটি ৫৩ লাখ ডলার বাদ দিয়ে নিট হিসাব দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। বাংলাদেশের এফডিআইয়ের বড় অংশই আগে থেকে দেশে বিনিয়োগ করা কোম্পানির আয় পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে আসে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ অর্থবছরেও এফডিআই কমেছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছর দেশে ১৪৭ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। এ বিনিয়োগ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। ওই অর্থবছর ১৬১ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল।
সামগ্রিকভাবে এফডিআই কমে যাওয়ার নতুন বিনিয়োগ (ইকুইটি) ও পুনর্বিনিয়োগ কমেছে। গত অর্থবছরে আসা মোট ১৪৭ কোটি ডলারের এফডিআইয়ের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ৬৭ কোটি ডলার হচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগ আসার হার দুই অর্থবছর ধরেই কমছে।
কেকে/এআর