বুধবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫,
১৬ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

বুধবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: জুলাই বিপ্লবে আহত ৬ জনকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ডে      সুযোগ পেলেই পুরোনো চেহারায় ফিরছে পুলিশ      গণশিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে আজ সারাদেশে মানববন্ধন      চতুর্থ দিনে কর্মবিরতি প্রত্যাহার, ডিপো থেকে তেল উত্তোলন শুরু      রেলের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক      ‘জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন’      তারেক রহমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন: নয়ন       
মুক্তমত
কালীপূজা ও খোকসার কালী
ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়
প্রকাশ: সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫, ৯:০৪ পিএম  (ভিজিটর : ৭২)
ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

ভক্তি ধর্মের বাহন! ধর্মের মধ্যে তাই ভক্তিকে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়। পৃথিবীর সব ধর্মের কমবেশি ভক্তি আছে।তবে সব ধর্মে ভক্তি নিবেদনের মাধ্যম এক নয়। সনাতন ধর্ম ভক্তি নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে নির্মল সৌন্দর্যের প্রতীক, পুষ্পকে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই পূজা পুষ্পের ভেতর দিয়েই সম্পন্ন হয়। পূজা অর্থাৎ পুষ্পকর্ম, ফুল দিয়ে অর্চনা। আসলে বনফুলে পূজা হয় না, ‘মনফুল’ দিয়েই পূজা করতে হয়। ‘মনফুল’কে প্রত্যক্ষভাবে দেবতার পায়ে অর্পণ করতে না পেরে আমরা বনফুল দিয়ে থাকি। কিন্ত বনফুলের সঙ্গে ‘মনফুল’ অঞ্জলি হয়ে থাকে। মনকে দেবতার পায়ে নিবেদন করবার উপযুক্ত সুন্দর শুভ্র মাধ্যম পুষ্প। তাই বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন - পুষ্প আপনার জন্যে ফোটে না, তোমার হৃদয় কুসুমকে পরের জন্যে প্রস্ফুটিত করিও।

প্রাচীনকালে সনাতন ধর্মে ফুল দিয়ে অর্চনা অর্থাৎ পূজা ছিল না। উপনিষদের ঋষিগণ নিরাকার ব্রহ্মের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। কিন্ত কালক্রমে ফুল দিয়ে অর্চনা আরম্ভ হয়। পুরাণের উপাসনার নামও পূজা কেবল পরিবার পরিজনের মঙ্গলের জন্যে নয়, বিশ্বের কল্যাণের জন্যেই অনুষ্ঠিত হয়।

সনাতন ধর্মে বিভিন্ন প্রকার পূজা হয়ে থাকে। কেউ ফুলে-জলে করেন, আবার কেউ ষোড়শোপচারে করেন। তারা গরমের দিনে পাখার বাতাস আর শীতের দিনে পশমি কাপড়ে মূর্তিকে অবরিত করতে দ্বিধা করেন না। যিনি শীত ও গ্রীষ্মের জন্মদাতা, যার শাসনে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তাঁরা, আকাশ, বাতাস সর্বদা নিজ নিজ কাজে নিযুক্ত রয়েছেন, তিনি যে শীত ও গ্রীষ্মে কষ্ট পান- এটা কল্পনা। ভাবগ্রাহী জনার্দন ভাবের ভিখারি, ভক্তির কাঙ্গাল, দ্রব্যের নয়। ভক্তি ভাবটুকুই তিনি গ্রহণ করেন। 

সাকারকে অবলম্বন করেই মূখ্যত পূজা হয়ে থাকে। সাকার পূজা করতে করতে মন নির্মল হয়।বুদ্ধি উন্নত হয় আর নিরাকার নির্গুণ স্বরূপের ধারণাশক্তি জন্মে। মনের ভাবধারার বিকাশ সাধন করাই হচ্ছে পূজার আসল উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যেই ভগবানকে রক্ষকত্বে বরণ করতে হবে, তাঁকে একান্তভাবে আত্নসমর্পণ করতে হবে।

এতক্ষণ গেল পূজার কথা। এবার আসা যাক কালীর কথায়। কালীর কথা বলতে গেলেই শক্তি উপাসনার কথায় আসতে হয়। সমগ্র বিশ্ববিধানের অন্তরালে একটি সর্বশক্তিময়ী মাতৃকাবোধের প্রভাব অতি সর্বশক্তিময়ী মাতৃকাবোধের প্রভাব অতি প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতায় স্বকৃতিলাভ করে আসছে। ঋগ্বেদেও এই আদ্যাশক্তি উল্লেখ আছে।মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কালিকা পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে এই দেবীর আখ্যান নানাভাবে উল্লেখিত হয়েছে। পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেঞ্জোদারো নগরে শক্তিপূজা প্রচলিত ছিল। এই দুই নগরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অসংখ্য মৃঁন্ময়ী দেবীর মূর্তি আবিষ্কার হয়েছে।

নারীশক্তির পূজা মূখ্যত প্রাচীনকালের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার থেকেই শুরু হয়। তখন নারীরাই ছিল পরিবারের প্রধান। আজ থেকে আট হাজার বছর পূর্বে ভোলগা নদীর তীরে প্রথম একটি মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের পরিচয় পাওয়া যায়। যে পরিবারের কর্ত্রী ছিলেন ‘নিশা’। আবার সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের কর্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায় - এমন একটি পরিবারের প্রধানের নাম ‘দিবা’। এই নারীর জন্যেই জনের (প্রজাতন্ত্র) সব প্রকার প্রতিষ্ঠা আসতো বলে সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করতেন। নারীরশক্তি ও মাতৃত্ব এমনিভাবে বহুকাল পূর্ব থেকেই পূজা পেয়ে আসছিল।

বাঙালির শিরায় শিরায় শক্তি - ভাবধারা দীর্ঘকাল থেকে প্রছন্নভাবে বয়ে আসছে। বহুকাল থেকেই এদেশ তন্ত্রধ্যান মাতৃকাপূজার পীঠস্থান, উপরন্তু প্রাচীর বৈদিক যুগ থেকে পৌরাণিক যুগের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগ পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষেই আদ্যাশক্তি কোনো না কোনো প্রকার পূজা উপাসনা চলে আসছে। নারীশক্তির পূজার একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে দুর্গা। দুর্গা চণ্ডীরই নামবিশেষ। ঋগ্বেদে দুর্গা অরুযী (অরুণ বর্ণ) নামে পরিচিত। ঋগ্বেদে এই দেবীর পূজার ব্যবস্থা নেই, তবে স্তব আছে। একথা মনে করার যথেষ্ট হেতু আছে যে, এই দেবীর পূজা লোকসমাজে প্রচলিত ছিল।

ঋগ্বেদে উষার উপাসনা থেকে পরবর্তীকালে পার্বতী বা দুর্গাপূজার উৎপত্তি হয়েছিল।

পার্বতী বা দুর্গা গুহার মধ্যে থাকলে তিনি কালী, গুহামুখে অর্থাৎ গুহার বাইরে থাকলে তিনি গৌরী। লোকসমাজে পূজা পাওয়ার জন্যে দেবী গুহামুখেই থাকেন গৌরী রূপে। তাই তাঁর আরেক এক নাম দ্বারবাসিনী। দুর্গার এই দ্বারবাসিনী গৌরী রূপেই আমরা পূজা করি। দেবীর এই ভিতরে কালো আর বাইরে সাদা রূপের উল্লেখ মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবীর কাহিনীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধের আগে দেবী পার্বতী দেবতাদের প্রবুদ্ধা হয়ে তাঁর ‘অম্বিকা স্বরূপ’ (গৌরী রূপ) প্রকট করলেন - তখন দেবতাদের মনে হয়েছিল তার দেহ থেকে অম্বিকা বেরিয়ে আসবার পর যে খোলস রইল তা কালী হয়ে গেল (৮৫ অধ্যায়, মার্কণ্ডেয় পুরাণ)। পার্বতী হলেন পর্বতবাসিনী দেবী যাকে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে হৈমবতী ঊমা, আর পুরাণে বলা হয়েছে দেবী শারদা। ঋগ্বেদের বর্ণনায় দেবী হলেন আসলে গুহাবাসিনী আশ্রয়দাত্রী অন্ধকারের রাত্রির দেবী। তিনি প্রকাশ হন ঊষা রূপে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের কাহিনীতেও তাই। এই দেবী আরাধনার বিশেষ তাৎপর্য আছে। দশম দলে কুলকুণ্ডলিনীতে হাদিনী শক্তির অবস্থান। এই হাদিনীকে জাগ্রত করেই সাধনা করতে হয়।

শক্তি ঊর্দ্ধদেশে গিয়ে পরম শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাধককে সিদ্ধপদবাচ্য করে। শক্তির প্রতীক অসুরকে বা অশুভকে বিনাশ করতে হলে শক্তির প্রয়োজন।

কালী নারীরুপিনী কেন?
নারী যদি অসুর বা অশুভকে আশ্রয় দেয় তাহলে আর কেউ তাকে বধ করতে পারে না। তাই নারীরই কর্তব্য জীবন ও জগৎকে সুস্থ ও স্ফুর্ত করে তুলতে অসুর ও অশুভকে নাশ করা। শুধু কালীপূজাতেই এই সত্য সীমাবদ্ধ নয়। আজও যদি বিশ্বে কেউ শান্তি আনতে পারেন তাহলে তিনি নারী। নারীই পারে আসন্ন পারমানবিক যুদ্ধ বন্ধ করতে। তাই আজকের বারুদাগার বিশ্বে শান্তির জন্য প্রয়োজন কল্যাণী নারীর চির কল্যাণময়ী হস্ত। ধ্বংসন্মুখ পৃথিবী তাই চেয়ে আছে কল্যাণী নারীর দিকে। ব্রক্ষ্মশক্তি, ব্রক্ষ্ম এবং শক্তি অভিন্ন। তাই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন- ‘যেমন জল ও তাহার তরলতা, দুগ্ধ ও তাহার ধবলত্ব মণি ও তাহার জ্যোতি, সমুদ্র ও তাহার তরঙ্গ অভিন্ন। ব্রক্ষ্ম ও শক্তিও তেমনি অভেদ। যিনি কালী, তিনিই ব্রক্ষ্ম’। তাইতো সাধক রামপ্রসাদের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে - ‘কালী ব্রক্ষ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি’।

একসময় আর্য সমাজে সাকার উপাসনা ছিল না। কালক্রমে সাকার উপাসনা প্রবেশ করে। জীবন যখন জটিলতার পথে অনেকখানি এগিয়ে গেল - তখন মানুষ নিরাকারে আর মনস্থির করে রাখতে পারল না। ফলে চিন্ময়ীর ধ্যান থেকে মৃণ্ময়ীর উৎপত্তি হলো।

শুধু কালীপূজা নয় - সনাতন ধর্মে এমন অনেক সাকার উপাসনার পদ্ধতি বিরাজমান। তাই বলে সনাতন ধর্মে সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্ব নেই। বরং এক উদার দার্শনিক আধ্যাত্মিক আর্দশ এই ধর্মের সকল মত ও পথকে এক মিলন মহাসাগরে লীন করেছে। সনাতন ধর্ম সাকার নিরকার, লৌকিক, বৈদিক, যুক্তিমার্গ, স্বধর্ম, পরধর্ম, স্বদেশ, বিদেশ সবাইকে শ্রদ্ধার উদার আসনে বসিয়ে চিরকাল ধরে অখণ্ড মানব মিলনমেলার রাগিনিই বাজিয়ে চলেছে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক তিলোত্তমা

কেকে/এজে
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

সালথার জয়ঝাপ উচ্চ বিদ্যালয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
ভারতে ‘পবিত্র স্নান’ করতে গিয়ে ১৫ জন নিহত
জুলাই বিপ্লবে আহত ৬ জনকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ডে
আদিতমারীতে কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত
সুযোগ পেলেই পুরোনো চেহারায় ফিরছে পুলিশ

সর্বাধিক পঠিত

ভিসা প্রতারক তাঁতী লীগ নেতা ‘সাহাবুল’ গ্রেফতার
ফেব্রুয়ারিতে ‘কঠোর’ হরতাল ও অবরোধ ডেকেছে আওয়ামী লীগ
ডোমারে ছেলের কোদালের আঘাতে বাবার মৃত্যু
নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করতে মুসল্লিদের মাঠের বেড়া ভাংচুর
‘অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে’

মুক্তমত- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝