বুধবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫,
১৬ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

বুধবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: রেলের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক      ‘জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন’      তারেক রহমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন: নয়ন       সাত কলেজ নিয়ে জরুরি সভা ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা      জনগণের বিপক্ষে গেলে ৫ আগস্টের মতো পরিণতি: তারেক রহমান      দেশে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ      ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের ঘোষণা      
বাতিঘর
ফরায়েজি আন্দোলনের মহানায়ক হাজী শরীয়তুল্লাহ
খোলা কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫, ৯:৩৪ পিএম  (ভিজিটর : ২২)

হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন বাংলার মুসলমানদের জন্য এক অসীম সাহসী পুরুষ! হাজী শরীয়তুল্লাহ যেমনি ছিলেন ইসলাম প্রচারক ও সমাজসংস্কারক, তেমনি তিনি ছিলেন ব্রিটিশবেনিয়া ও অত্যাচারী জমিদারদের শোষণ থেকে বাংলার গণমানুষের মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক। তার প্রতিষ্ঠিত ফরায়েজি আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে সূচিত হলেও পরবর্তী সময়ে সেটি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলনে রূপ লাভ করে। তার হৃদয়ে ছিল ইসলামের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। দেশের জন্য ছিল অঢেল প্রেম। মানুষের জন্য ছিল পরম মমতা। আর তাই বাংলার মানুষকে আঁধার থেকে আলোয় আনার জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ সারাটি জীবন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

শরীয়তুল্লাহর জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুর জেলার চর শামাইল গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে। ছোটোবেলায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। তিনি তার গুরু মওলানা বাশারত আলীর সঙ্গে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে গমন করেন এবং ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আরবি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন।

আরব বিশ্বে হাজী শরীয়তুল্লাহ

মক্কায় গিয়ে শুরু হয় হাজী শরীয়তুল্লাহর নতুন জীবন। তিনি যেন আবে হায়াতের সন্ধান পেয়ে যান। তিনি যে ইলম অর্জনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তা আশার চেয়েও বেশি পরিমাণে পেয়ে যান। সান্নিধ্য পান যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের। হাদিস, তাফসির ও বিশেষত হানাফি ফিকহের ওপর তিনি অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহারেও দুই বছর অবস্থান করে ইসলামি জ্ঞান ভান্ডারের আরো গভীরে ডুব দেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি আরবেই অবস্থান করতে থাকেন। সেখানেও তার প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়েই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। সেখানে তিনি ইলমে দ্বীনের পাঠদান করতে থাকেন। বাংলার এক এতিম বালক নবীর দেশে হয়ে ওঠেন ইলমের ফেরিওয়ালা। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত তিনি আরবে ছিলেন।

এ সময় তার চোখের সামনেই আরবে নানা উত্থান-পতন হয়। বিশেষ করে ওয়াহেবি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াব নজদীর সংস্কার আন্দোলনে আরব নতুন করে সেজে ওঠতে থাকে। মক্কায় অবস্থান করাকালে হাজী শরীয়তুল্লাহ মুসলিম বিশ্বের নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষের দেখা পান। গভীরভাবে অবলোকন করেন মুসলিম বিশ্বের আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি। মনে গেঁথে নেন ইসলামের প্রকৃত রূপ। বিশেষ করে এ সময়েই হজের উদ্দেশে মক্কায় আগমন করেন ভারতের মুসলিম জাগরণের অন্যতম সিপাহসালার সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)। তিনি বিশাল অনুসারী বাহিনী নিয়ে এক বছর মক্কায় অবস্থান করেন। মুসলমানদের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি করার জন্য তিনি জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ সাইয়েদ আহমদ শহীদের দ্বারাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এভাবে মক্কায় অবস্থানের ২০ বছর সময়ের মধ্যে হাজী শরীয়তুল্লাহর ভেতরে মুসলিম নবজাগরণের এক বিপ্লবী আগুন জ্বলে ওঠে।

ফরায়েজি আন্দোলন


বাংলার মুসলমানদের মাঝে বেশ কিছু সংখ্যক ছিল ধরমান্তরিত। তাই মুসলমান হওয়ার পরও স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে পূর্বধম ও সংস্কৃতির অনেক কিছুর প্রভাব থেকেই যায়। এগুলো প্রকট হয়ে দেখা দেয় বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। মক্কায় তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মক্কায় থাকাকালীন তিনি সংকল্পবদ্ধ হন যে, দেশে ফিরে তিনি সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হবেন। তাই তিনি মক্কা থেকে দেশে ফিরে সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে তার নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। তিনি দুই রকম পাপ থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার কথা বলেন। প্রথমটি ‘শিরক’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘বেদাত’।

এই লক্ষ্যে তিনি মুসলমানদের দুই দফা নির্দেশনা দেন—
আত্মবিশ্বাস জাগ্রতকরণ : এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা। কারণ সে সময়ের মুসলমান সমাজ প্রবর্তিত পীর পূজা, কবর পূজা, মনসা পূজা, শীতলা পূজা ইত্যাদি নানা ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড দ্বারা গোটা বাংলার মুসলমান সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারগুলো বিদূরিত করে কুরআন ও সুন্নাহ মতে জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করা এবং ইসলামের ‘ফরজ’ কাজগুলো অবশ্যম্ভাবী পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানান। আর এ ‘ফরজ’ কথাটি থেকেই ফরায়েজি শব্দটি এসেছে।


মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা : তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দূরবীক্ষণ দ্বারা অনুভব করেছিলেন যে, ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ছাড়া ভারতবর্ষের জনগণের মুক্তি অসম্ভব। আর এজন্য তিনি দরিদ্র কৃষক, তাতি শোষক শ্রেণিকে মহাজন, জমিদার নীলকর বণিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেন। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিল আধুনিক ও মানবতাবদী। তৎকালীন সমাজের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারণে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানগণেরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা ও ফরায়েজি আন্দোলন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেননি। বরং তিনি চেয়ে ছিলেন ধর্মীয় জীবনে পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মুসলমানরা যেন নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে।

ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব

হাজী শরীয়তুল্লাহর এ আন্দোলন মুসলমানদের সামাজিক জীবনে গভীরভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দলে দলে গ্রামবাংলার মুসলমানগণ ফরায়েজি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সমাজজীবন থেকে কুসংস্কারগুলো দূর করতে মুসলমানগণ ইসলামি চেতনার সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। মহাজন, জমিদার ও নীলকর বণিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নেয়। ইসলামি চেতনা ও দৃঢ় সংগ্রামী মনোবলে উজ্জীবিত মুসলমানদের নিকট মহাজন, জমিদার, নীলকর বণিক তথা অত্যাচারী শ্রেণি বিভিন্ন জায়গায় পরাজয় বরণ করে।

১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তার সুযোগ্য পুত্র মুহাম্মদ মুহসীন ওরফে দুদু মিয়া। দুদু মিয়ার অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিচক্ষণ্নতার কারণে ফরায়েজি আন্দোলন জীবনীশক্তি ফিরে পায়। তারই অক্লান্ত কর্ম তৎপরতায় এ আন্দোলন সামাজিক ও ধর্মীয় গন্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। তার লক্ষ্য ছিল কৃষকদেরকে জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। দুদু মিয়া সমগ্র বাংলাকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রতিটি অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য তিনি একজন প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করেন। এসব প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় ফরায়েজি সংগঠিত করতেন। ১৮৪৩ সালে ফরায়েজির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। বর্ষীয়ান ফরায়েজিদের দিয়ে আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আদালত সব ধরনের বিরোধের বিচার করত। পূর্ব বাংলার কৃষককুল ও মুসলমানদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় ও আত্মশুদ্ধি আনয়নের ক্ষেত্রে তদুপরি জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলন এক মাইলফলক।

সম্মননা

শরীয়তুল্লাহ’র নামানুসারে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া তার নামে মাদারীপুরের শিবচরে আড়িয়াল খাঁ নদের উপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে হাজী শরীয়তুল্লাহ সেতু যা ৪৫০ মিটার দীর্ঘ। ১০ মার্চ ১৯৯৩ সালে তার নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাকটিকিট বের করে। তার জীবনী একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় এতে শরিয়তুল্লাহ চরিত্রে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

মৃত্যু

হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৮৪০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বর্তমানে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃতদেহ জন্মস্থান চর শামাইলে সমাহিত করা হয়। আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনের ফলে হাজী শরীয়তুল্লাহর কবর নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবে বাহদুরপুর মাদ্রাসা-মসজিদ প্রাঙ্গণে পারিবারিক কবরস্থানে পুত্র দুদু মিয়াসহ অন্যদের কবর রয়েছে।

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

জয় শাহের দায়িত্ব গ্রহণের পরেই আইসিসির প্রধান নির্বাহীর পদত্যাগ
রেলের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
কম সুদর্শন পুরুষই স্ত্রীকে বেশি সুখী রাখে, বলছে গবেষণা
কুমিল্লায় চোর ধরতে গিয়ে কনস্টেবলের মৃত্যু
বাংলাদেশপন্থীদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধপন্থী হতে হবে: মাহফুজ আলম

সর্বাধিক পঠিত

জয়পুরহাটে ট্রাক চাপায় অটোরিকশা চালক নিহত
ভিসা প্রতারক তাঁতী লীগ নেতা ‘সাহাবুল’ গ্রেফতার
ফেব্রুয়ারিতে ‘কঠোর’ হরতাল ও অবরোধ ডেকেছে আওয়ামী লীগ
ডোমারে ছেলের কোদালের আঘাতে বাবার মৃত্যু
নোয়াখালীতে চাষীরহাট নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝