ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তাদের সমর্থনে মত দিচ্ছেন তরুণ জনগোষ্ঠীর মাত্র ২৫ শতাংশ। শুধু তারাই মনে করছেন ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা উচিত। তবে পুরোনো রাজনৈতিক দলেগুলোতেই আস্থা রাখতে চান বাকি ৭৫ শতাংশ তরুণ। তরুণ-তরুণীদের বড় এই অংশের চাওয়া পুরোনো দলগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বহিষ্কার করে তুলনামূলক ভালো নেতাদের গুরুত্ব দিক। একইসঙ্গে তারা চান দেশে দুর্নীতি বন্ধ হোক, স্বজনপ্রীতি দূর হোক, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, নাগরিকদের-বিশেষ করে নারীদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত থাকুক।
রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত বিওয়াইএলসি’র প্রধান কার্যালয়ে সোমবার ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে’ শীর্ষক জরিপের ফলাফল উপাস্থাপনে এসব তথ্য জানানো হয়। সরাসরি এবং অনলাইন দুই মাধ্যমের জরিপেই তরুণদের আকাক্সক্ষা ও উদ্বেগ উভয়ই উঠে এসেছে। বিওয়াইএলসির মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন বিভাগ ও রিসার্চ ম্যানেজার আবুল খায়ের সজীব জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। জরিপে তরুণদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিপ্রয়াণ বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়।
বিওয়াইএলসির এবারের সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, সরাসরি জরিপে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে আসার পক্ষে মত দিয়েছেন ৩০.৯ শতাংশ তরুণ এবং সংস্কার ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের অপসারণ চান ৪০.৪ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার পক্ষে মত দিয়েছেন ২৮.৪ শতাংশ তরুণ। অন্যদিকে অনলাইন জরিপে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে আসার পক্ষে মত দিয়েছেন ২৯.৩ শতাংশ তরুণ এবং সংস্কার ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের অপসারণ চান ৪৪ শতাংশ তরুণ। আর নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার পক্ষে মত দিয়েছেন ২৫ শতাংশ তরুণ।
১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের তরুণদের মধ্যে সরাসরি জরিপে ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ও অনলাইন জরিপে ৯৫.৭০ শতাংশ তরুণ আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ সম্পর্কে সরাসরির জরিপে ৭৩.৪ শতাংশ তরুণ বলেছে অবাধ, সুষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া ৬২ শতাংশ তরুণের মত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা উচিত এবং ৪১ শতাংশ তরুণ মনে করছেন সংবিধান সংস্কার করা উচিত।
বিগত সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমানে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে নিজেদের মতামত প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সরাসরি জরিপে ৭৩.৬ শতাংশ এবং অনলাইন জরিপে ৮১.৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী।
সরাসরি জরিপে অংশ নেওয়া ২০ দশমিক ৯০ শতাংশ ও অনলাইন জরিপে অংশ নেওয়া ৫৪ দশমিক ৪০ শতাংশ তরুণ নিশ্চিত নন যে বাংলাদেশে শান্তি শৃংখলা বিরাজ করছে কিনা। অপরদিকে, সরাসরি জরিপে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ ও অনলাইনে ৭০ শতাংশ তরুণ মনে করেন যে বর্তমান বাংলাদেশে মেয়ে ও নারীরা নিরাপদ বোধ করতে পারছে না।
বর্তমানে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ সরাসরি ও ৫১ দশমিক ৫০ শতাংশ তরুণ অনলাইন জরিপে ভবিষ্যৎ পেশা হিসেবে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছে।
সরাসরি ও অনলাইন জরিপে যথাক্রমে ৭১ শতাংশ ও ৮৬ দশমিক ৪০ শতাংশ তরুণ মনে করে যে, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার অবাধ পরিবেশ বজায় রাখার অন্তরায়। এ ছাড়া সরাসরি জরিপে ৭৭.৪০ শতাংশ তরুণ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান করে মনে করলেও অনলাইন জরিপের ক্ষেত্রে ৭৯.৩ শতাংশ তরুণ তা মনে করেন না।
সরাসরি ও অনলাইন জরিপে যথাক্রমে ৭৫.১০ শতাংশ ও ৬৪.৮০ শতাংশ তরুণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে নিজেদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এ ছাড়া সরাসরি জরিপে ৮৬.৪০ শতাংশ ও অনলাইন জরিপে ৩৯.২০ শতাংশ তরুণ মনে করে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় আছে। পক্ষান্তরে, অনলাইন জরিপের ২৪.৫০ শতাংশ তরুণ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। একইসঙ্গে সরাসরি জরিপে ৬৮.৬০ শতাংশ ও অনলাইন জরিপ ৮৪.৯০ শতাংশ তরুণ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ প্রদর্শন করা উচিত নয়।
সরাসরি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত জরিপে যথাক্রমে ২৮.৯০ শতাংশ ও ৪৯.৫০ শতাংশ তরুণ মনে করে বাংলাদেশের মিডিয়া বাংলাদেশের সমসাময়িক অবস্থার সঠিক তথ্য প্রচার করে না।
বিদেশমুখী তরুণদের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, দেশের ২১.৮ শতাংশ তরুণ সরাসরি জরিপে ও ৪৭.৮ শতাংশ তরুণ অনলাইন জরিপে জানিয়েছে তারা বিদেশে স্থায়ী হতে চায়। তবে আশার কথা এই যে, বেশির ভাগ আবার দেশে ফিরে আসতে চায়।
বিওয়াইএলসি’র নির্বাহী পরিচালক তাহসিনাহ আহমেদ বলেন ‘যুব সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী আগামীর রূপরেখা তৈরির জন্য ইয়ুথ ম্যাটারস সার্ভে একটি প্রমাণভিত্তিক দলিল। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যুবসমাজ সবার আগে সংস্কার চায়। তারা চায় দেশে দুর্নীতি বন্ধ হোক, স্বজনপ্রীতি দূর হোক, নাগরিকদের বিশেষ করে নারীদের অধিকার, নিরাপাত্তা ও সম্মান নিশ্চত থাকুক। তারা নির্ভয়ে কথা বলার পরিবেশ চায়। তারা দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ চায়। তারা বলেছে যে এসব সংস্কার কার্যকর করার জন্য সরকারকে সময় দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সরকারের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে তারা কাজ করতে চায়। কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক দল আসুক তা চাইলেও বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী চায় যে পুরোনো দলগুলোর সংস্কার হোক, রাজনীতিতে ভাল মানুষ প্রার্থী হিসেবে আসুক। তাদের আকাক্সক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করা আমাদের সবার দায়িত্ব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, ‘নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলে আস্থা তৈরি হতে সময় লাগে। পুরোনো দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী এবং তরুণদের সঙ্গে একটা সংযুক্তি তৈরি হয়েছে। এটা থেকে তরুণরা ভাবছে আগের রাজনৈতিক দলগুলোই ঠিক আছে, কিন্তু সংস্কারের মধ্য দিয়ে আসুক।’
বিওয়াইএলসি’র স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের ডেপুটি ম্যানেজার মুনিরা সুলতানা বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে পারছে না। এ সমস্যার সমাধানে বিওয়াইএলসি তাদের প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে সমস্যা সমাধান, সংঘাত নিরসন এবং জনসমক্ষে কথা বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো অন্তর্ভুক্ত করছে, যাতে শিক্ষার্থীরা শ্রম বাজারের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
বিওয়াইএলসি’র অফিস অব প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট-এর ডেপুটি ম্যানেজার আহসান হাবিব বলেন, ‘ইয়ুথ ম্যাটারস সার্ভে দেখিয়েছে যে যুবসমাজ রাজনৈতিক দলে সংস্কার দাবি করছে, প্রচলিত পদ্ধতিগুলো প্রত্যাখ্যান করছে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থবহ পরিবর্তন চাইছে। তারা শুধু পরিবর্তন চায় না তারা পরিবর্তনের অংশ হতে চায়।
বিওয়াইএলসি-এর কমিউনিকেশন, মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার কাযরিয়া কায়েস বলেন, ‘ইয়ুথ ম্যাটারস সার্ভে-তে দেখা গেছে, অনেক তরুণ সঠিক সুযোগ পেলে বাংলাদেশে ফিরে আসতে আগ্রহী, যা একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়।’
প্রসঙ্গেত, বিওয়াইএলসি’র ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে’ শীর্ষক জরিপে সমগ্র বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১৫৭৫ জন সরাসরি ও অনলাইনে ১৬৬৩ জন তরুণ অংশ নেয়। বিগত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ফলে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে, তাতে তরুণরা আগামীর বাংলাদেশ গঠনে কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে তা তুলে ধরাই এই জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল। জরিপে গবেষক হিসেবে আরো ছিলেন আরাফাত ইসলাম, ফজিলাতুন নেসা, জেসিয়া মারগারেট গোমেজ।
কেকে/এআর