গত বছরের জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানের মুখে পত ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট ভারতের পালিয়ে যান তিনি। পেছনে রেখে যান হতবিহ্বল হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। গণরোষ থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে চলে যান দলটির অনেক নেতাকর্মী। শীর্ষনেতাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন।
অভ্যুত্থানে অন্তত ৮৩৪ জন নিহত হয় বলে সরকারি হিসাবে বলা হয়। আরো ২০ হাজার জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের পর্দা নামে। পাঁচ মাস পরও আওয়ামী লীগ নিজেদের পুনর্গঠন করতে লড়াই করছে। দলের অভ্যন্তরে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়েছে একদিকে ক্ষমাশীল না হওয়া প্রবীণ নেতারা, আর অন্যদিকে মধ্যম স্তরের নেতাকর্মীরা যারা মনে করেন দলকে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এই বিভাজন কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা-ই দলটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এখনো দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাসিম ১৬ জানুয়ারি একটি অজানা স্থান থেকে আল জাজিরাকে ফোনে বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। এটা শিগগিরই প্রমাণিত হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন দাবি দলটির ব্যর্থতা স্বীকার করতে না পারা এবং জনগণের অসন্তোষ মোকাবিলায় অক্ষমতার পরিচায়ক। এর ফলে দলটির তৃণমূল কর্মীরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তাদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে আছেন বা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আইনি প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভীত। তারা আক্ষেপ করেন, দলটি জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত একটি সংগঠন থেকে একতরফাভাবে শীর্ষ নেতৃত্বাধীন কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা বলেন, অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভাব দলটিকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখনো ‘জুলাই আন্দোলন’ নামে পরিচিত ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণজাগরণের সময় তাদের সরকারের কঠোর পদক্ষেপের জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো ক্ষমা প্রার্থনা বা বিবৃতি দেয়নি। বরং দলটি বারবার এ আন্দোলনকে অস্বীকার করেছে।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ১১ বছর দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি ভারতের শীর্ষ দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ ‘ইসলামি সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভ্যুত্থানের’ শিকার হয়েছে। তবে দলের ঘনিষ্ঠ অনেকেই তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ দলে জবাবদিহিতার অভাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাট ও কোটি কোটি টাকা পাচারের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাইতে হবে। আমি এখনো আত্ম-উপলব্ধি, আত্ম-সমালোচনা বা অপরাধ স্বীকারের কোনো প্রমাণ দেখিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান মনে করেন, দলের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব ও সিদ্ধান্তগুলো জনরোষকে বাড়িয়ে তুলেছিল। সেই ক্ষোভই জাগরণের সফলতায় ভূমকা রেখেছে। তিনি বলেন, অতি উৎসাহী সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় আঘাত হানে, ফলে তার পদত্যাগ জনগণের একমাত্র দাবি হয়ে দাঁড়ায়।
প্রবাস জীবন বা পুনরুত্থানের অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনার জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য হত্যার পর হাসিনা দীর্ঘ সময় ভারতে ছিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নেন। দলের পুনর্গঠনে ও ক্ষমতায় ফিরে আসতে তাকে ২১ বছর লড়াই করতে হয়েছিল।
হাসানুজ্জামান বলেন, আওয়ামী লীগ এখন গুরুতর নেতৃত্ব ও ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এবং সামরিক বাহিনীর সমর্থনে দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়া দলের পুনর্গঠন কঠিন হবে এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনও বাড়বে।
এর মধ্যে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই বলেছে, গত জুলাই ও আগস্টে গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিচার হতে হবে। তবে তারা বলেছে, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে।
হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছাত্র আন্দোলনটি আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ২৫ জানুয়ারির এক পথসভায়, অন্তর্র্বতী ড. ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগকে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই নির্বাচনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অধ্যাপক হাসানুজ্জামান বলেন, যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, তাহলে এটি দলের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করবে। তবে নেতৃত্ব, সংগঠন ও তৃণমূলের সঙ্গে সংযোগ পুনরুদ্ধার ছাড়া আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক পুনরুত্থান অত্যন্ত কঠিন হবে।
এদিকে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের জন্য চারটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো ১৬ বছরের শাসনামলে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া; দলের বর্তমান মতাদর্শ পরিত্যাগ করা; শেখ হাসিনার পরিবারের কোনো সদস্যকে আর নেতৃত্বে না রাখা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সকল নৃশংস অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা। তিনি আরো বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় যেসব ব্যক্তি গণহত্যার জন্য সরাসরি দায়ী, তাদের বিচার হতে হবে, যার মধ্যে শেখ হাসিনাও অন্তর্ভুক্ত। এই শর্তগুলো পূরণ হলে তাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
বিদেশে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টকশোতে কর্মীদের পুনর্গঠনের আহ্বান জানাচ্ছেন। একইসঙ্গে দাবি করছেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যর্থ হতে চলেছে। কিন্তু এই বক্তব্য দলীয় কর্মীদের কাছে সেভাবে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।
কেকে/ এমএস