সাত কলেজের সম্বন্বয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্বাস দেওয়ায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন সাত কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। একই সাথে গতকাল ঘোষিত ছয় দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে ২৪ ঘন্টা পর নতুন কর্মসূচির ঘোষণার আল্টিমেটাম দেন তারা।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা কলেজ শহিদ মিনারের পাদদেশে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী সাগর। সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর আন্দোলনের ফোকাল পয়েন্ট আব্দুর রহমান।
আব্দুর রহমান বলেন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবির অধীনে চরম ভোগান্তির মধ্যে ছিলেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে, ঢাবির অধীনে আমাদের পরিচয় সঙ্কটের বিষয়টি। আমরা সরকারকে আমাদের সমস্যার বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তারা আমাদের কথা শুনেছেন। দাবির যৌক্তিকতা উপলদ্ধি করতে পেরেছেন এবং সবশেষ চূড়ান্তভাবে সাত কলেজের সমন্বয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্বাস দিয়েছেন, সেজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু গতকাল সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ঘোষিত ছয় দফা দাবির একটি বাস্তবায়ন হয়েছে, বাকি দাবিগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য আমরা বাকি দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য ২৪ ঘন্টা আল্টিমেটাম দিচ্ছি। ২৪ ঘন্টা পরে আমরা সকলের সাথে আলোচনা করে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত জানাবো।
৫ দফা দাবি সমূহ:
১. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটিকে আগামী পনেরো দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা প্রকাশ করতে হবে।
২. এক মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
৩. সকল বর্ষের চলমান পরীক্ষা পূর্বঘোষিত রুটিন অনুযায়ী চলমান হবে।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর সাথে সাথেই চলমান সকল শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫. উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাত কলেজের চলমান সংকট নিরসনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় এবং সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সাথে আগামী দুই দিনের মধ্যে টেবিল টকের আয়োজন করতে হবে।
কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারি সাগর বলেন, আমরা সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিলের দাবি নিয়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলন–কর্মসূচি করে আসছি। আমাদের দাবি ছিল অধিভুক্তি বাতিল করে সাত কলেজের সমন্বয়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করতে হবে। কারণ, যে লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে, সেটা প্রায় ৮ বছরেও অর্জন করা যায়নি। বরং অধিভুক্তির পর থেকে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানের উন্নতির পরিবর্তে আরো ভোগান্তি বেড়েছে। এসব ভোগান্তির বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে অনেক আন্দোলন–সংগ্রাম হয়েছে। বস্তুত যা ছিল সংস্কারের আন্দোলন।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে আমাদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা আসলে আর সংস্কার নয়; আমরা চূড়ান্ত মুক্তির আন্দোলন শুরু করেছি। এ আন্দোলনের শুরু থেকে আমরা সব মহল থেকে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছি। দীর্ঘ আন্দোলনের পর আমাদের দাবির বাস্তবতা উপলদ্ধি করে সরকারও সাড়া দিয়েছে। দাবি বাস্তবায়নে সরকার ইউজিসির সমন্বয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দেয়। যে কমিটি খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।
তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত এ কমিটি সাত কলেজের সবগুলো কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে কথা বলেছে। আমরা প্রতিটি কলেজ থেকে ২০–২২ জনের প্রতিনিধি গিয়ে ইউজিসিতে আমাদের সমস্যা–সম্ভাবনার কথা বলে এসেছি। এরপর ইউজিসির নেতৃত্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ এ কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলেছে। সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গেও এ কমিটির কথা হয়েছে। সবার সঙ্গে কথা বলে এ কমিটি সাত কলেজের সমন্বয়ে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা সম্ভব, সে সম্পর্কিত রূপরেখা জাতির সামনে প্রকাশ করবে সরকার সেটা বাস্তবায়ন করবে।
এই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা দেখেছি, এ পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাত কলেজের নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষা ভর্তি নিতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন গ্রহণ শুরু করেছে। আমরা দাবি জানিয়েছিলাম, যেহেতু সাত কলেজ একটা প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে যেন ঢাবি আর শিক্ষার্থী ভর্তি না নেয়। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা গত ২৬ জানুয়ারি ঢাবির প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের কার্যালয়ে দেখা করতে যাই। সেখানে তিনি আমাদের সাত কলেজের প্রতিনিধিদের লাঞ্ছিত করে বের করে দেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ জানায়। পরে ওইদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের নিউমার্কেট ও নীলক্ষেত এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রাকিবসহ অনেকে হতাহত হয়েছেন। রাকিব এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। শুধু রাকিব নয়, ঢাবির অধীনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষার অধিকার আদায়ে বারবার রক্ত ঝরিয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর অঙ্গহানী হয়েছে। ২০১৭ সালে পরীক্ষার রুটিন প্রকাশের দাবির আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেলে আমাদের তিতুমীর কলেজের বড় ভাই সিদ্দিকুর রহমান চোখ হারিয়েছেন।
সবশেষ পরিস্থিতি হলো, গতকাল ২৭ জানুয়ারি দুপুরে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদের কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলসহ একাধিক সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উল্লেখ্যযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো হলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক বছর এগিয়ে এনে এ বছর থেকেই, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ভর্তি না নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী আসনসংখ্যা, ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীন রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবে, যাতে তাঁদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ঢাবির সিদ্ধান্তকে সাদুবাদ জানিয়ে কবি নজরুল কলেজের এই শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের দাবির যথার্থতা উপলদ্ধি করে অধিভুক্তি বাতিলের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, এটার জন্য আমরা ঢাবি কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, ঢাবির অধীনে আমাদের সত্যিকারের কোনো কার্যকর ট্রিটমেন্ট হচ্ছিলো না। ঢাবির নিজেদের শিক্ষার্থীরাও এমন অধিভুক্তির বিপক্ষে ছিলেন। আরো আগেই দুপক্ষের জন্য এমন সম্মানজনক পৃথকীকরণ দরকার ছিল। দেরিতে হলেও ঢাবি কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার জন্য আবারও তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
এদিন দুপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে সচিবালয়ে এক বৈঠক করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা। এ বৈঠকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা প্রত্যাহার করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। বৈঠকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় রূপান্তরের জন্য সরকারকে ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।
কেকে/এএম