শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫,
১৮ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান গ্রেফতার      ঝড়-তুফান যাই হোক না কেন, নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হতেই হবে: তারেক রহমান      জামালপুরে ট্রাক- সিএনজির সংঘর্ষে নিহত ৫      বাংলাদেশে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস জাপানের      ভারতের বাঁধের কারণে আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে গেছে: তারেক রহমান      পবিত্র শবে বরাত ১৪ ফেব্রুয়ারি      চার কি.মি. হেটে টিউশনি করা তৌহিদ অনেকের প্রেরণার উৎস      
গ্রামবাংলা
চার কি.মি. হেটে টিউশনি করা তৌহিদ অনেকের প্রেরণার উৎস
ছয়বারের সেরা করদাতা
হাসান আল সাকিব
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫, ৭:৩৪ পিএম  (ভিজিটর : ১২৪)
 সফল উদ্যোক্তা তৌহিদ হোসেন । ছবি: প্রতিনিধি

সফল উদ্যোক্তা তৌহিদ হোসেন । ছবি: প্রতিনিধি

তৌহিদ হোসেন। ছাত্র জীবন থেকে  দীর্ঘ সংগ্রাম, চেষ্টা, অধ্যাবসায় আর সততার বলে বলিয়ান হয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসায়ীক সফলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানবসেবা দেশপ্রেম সবকিছুর মিশেলে এই তৌহিদ  যেনো কবি নজরুল কবিতার সেই বীর যার 'চির উন্নত মমশীর'।

রংপুর নগরীর জুম্মা পাড়ায় এক ব্যবসায়িক পরিবারে ১৯৮৭ সালের ১০ ই মে  সাফায়েত হোসেন ও ইশরাত বেগম দম্পত্বির কোল আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন তৌহিদ। তবে ব্যবসায়িক বাবা হঠাৎ লোকসানে পড়ায় ছাত্র জীবনে একটি সাইকেল ক্রয় করা সম্ভব ছিল না। তাই ৪ কি.মি. পথ পায়ে হেটে টিউশনি করতেন তৌহিদ হোসেন। আজ তিনি অনেকের প্রেরণার উৎস।

মোটরসাইকেল পার্টস ব্যবসায়ী হিসেবে উত্তরবঙ্গের সুপরিচিতি অর্জন করার পর ২০০৮ সালে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন তৌহিদ। শুরু করেন রেন্ট-এ-কার মাইক্রো ও পিকআপের ব্যবসা। এরপর জড়িয়ে পড়েন ইজিবাইক ও ব্যাটারি বিক্রির ব্যবসায়। রংপুর, কুড়িগ্রাম, রাজারহাট, লালমনিরহাট, তুষভাণ্ডার, সৈয়দপুর, গাইবান্ধা, ঢাকার ডেমরাসহ রংপুর বিভাগে ১৬টি ইজিবাইক ও ব্যাটারি বিক্রির প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি। সেই থেকে সমাজে তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন তৌহিদ। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে রয়্যালটি মেগামল নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেনাবাহিনী পরিচালিত আরএমসি মার্কেটে রয়্যালটি মেগামলের পাঁচটি আউটলেট ও রয়্যালটি ফুড আড্ডা নামে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেন। এছাড়াও রয়েছে ইজিবাইকের ব্যাটারি কারখানা 'তৌহিদ ব্যাটারি'। আর এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন শতাধিক বেকারের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। পরপর ছয়বার রংপুরের সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেনও তিনি।

এই উদ্যোক্তার সংগ্রাম মুখর বেড়ে উঠার গল্প উঠে এসেছে খোলা কাগজের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

খোলা কাগজের প্রতিবেদককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তৌহিদ হোসেন জানান, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সেন্ট সায়মুন কিন্ডার গার্টেনে (বর্তমানে ল কলেজ) বাবার গাড়িতে করে স্কুলে যেতাম। কিন্তু বাবার ব্যবসায়িক লোকসানের কারণে সব ফিকে হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ভর্তি হই গুপ্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। সেখান থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হই রংপুর হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। সংসারের দৈন্যদশার কারণেই শুরু করি টিউশনি। প্রথম মাসের টিউশনের সম্মানী ২০০ টাকা পাওয়ার পর তা দিয়ে মাকে শাড়ি কিনে দেই। সেই শাড়ি পেয়ে আমার মায়ের সেই খুশি মুখ আমাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়। পড়ালেখা ও টিউশনির পাশাপাশি আমি সংসারের আর্থিক অনটন কিভাবে কাটানো যায় সেই চিন্তা করতে থাকি। 

তৌহিদ হোসেন বলেন, আমার ফুফা নাইয়ার আজম ছিলেন মোটরসাইকেল পার্টস ব্যবসায়ী। সপ্তম শ্রেণিতে উঠা মাত্রই একদিন আমার মা আমার ফুফাকে অনুরোধ করেন, ভাই সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। আমার ছেলেটাকে ব্যবসা শেখাও। কিন্তু বয়স অল্পের কারণে প্রথমে ফুফা তাতে রাজি হলেন না। পরে একদিন আবারও মা আমাকে ফুফার কাছে নিয়ে গিয়ে একই আবদার করলেন। এবার ফুফা কথা ফেলতে পারলেন না। আমাকে ব্যবসা শেখাতে রাজি হলেন। আমার ডিউটি পরলো ফুফার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রতিটি উপজেলায় ফুফার সঙ্গে যাওয়া।

তিনি আরো  জানান,  সেই থেকে শুরু হলো ব্যবসা শেখার পালা। ফুফার সঙ্গে তার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সকালে যেতাম। ফিরতাম রাতে। বাসায় আসার সময় ফুফা আমাকে ১০০ টাকা দিতেন দিন হাজিরা। এভাবে একবছর তার পেছনে ঘুরে মোটরসাইকেল পার্টসের নাম, অর্ডার নেওয়া ও ডেলিভারি সিস্টেম শিখে ফেললাম। এর মধ্যে লেখাপড়াও চালাতে থাকলাম। অষ্টম শ্রেণিতে উঠে আমি ফুফাকে বললাম আমাকে আপনি যন্ত্রাংশ দাম কেটে দেন। আমি নিজে ব্যবসা করি। ফুফা আমার সাহস দেখে আমাকে উৎসাহিত করলেন। তিনি প্রথম দিন আমাকে ১৩ হাজার টাকার যন্ত্রাংশ দর কেটে দিয়ে বিক্রির জন্য দিলেন। সেই যন্ত্রাংশ আমি মিঠাপুকুর, শঠিবাড়ি ও বড় দরগায় গিয়ে বিক্রি করে প্রথম দিনে ১ হাজার ১৮০ টাকা মুনাফা করি। সেই টাকা মায়ের হাতে এনে দেই। এভাবে এক বছর ফুফার কাছ থেকে যন্ত্রাংশ ক্রয় করে বিক্রি করি। বছর ঘুরতেই পুঁজি দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকায়। এরপর আমি ফুফার সহযোগিতায় যশোর ও ঢাকা থেকে মহাজনদের কাছ থেকে মাল ক্রয় করে এনে জেলায় জেলায় উপজেলায় উপজেলায় ফেরি করে বিক্রি শুরু করি।

ফেরি করে পার্টস বিক্রি করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, একদিন দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে  মালামাল বিক্রি করে সৈয়দপুরের বাস ধরার জন্য স্ট্যান্ডে আসি। দেখি শেষ গাড়িটিও ছেড়ে দিচ্ছে। তখন এক মন ওজনের মালামালের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে বাসের পেছনের ছাদের উপরে ওঠার সিঁড়িতে লাফিয়ে উঠি। ওই বাসটিতে ছাদেও জায়গা ছিল না। খাঁচা ভর্তি মাছ ছিল। বাস রাস্তায় গিয়ে ব্রেক কষলে সেই মাছের পানি মাথাসহ সারা শরীরে পরে ভিজে যায়। এভাবে বার বার ভিজে ভিজে সৈয়দপুর আসি। সেখান থেকে রংপুর আসার জন্য আরেকটি বাসে উঠি। কিন্তু আমার শরীরের মাছের আঁশটে গন্ধ পুরো বাসে ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রীরা আপত্তি করলে তারাগঞ্জে এসে সুপারভাইজার আমাকে নামিয়ে দেয়। বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার পর সেদিন মাঝ পথে খুব কেঁদেছিলাম। 

তৌহিদ হোসেন বলেন, অনেক দিন গেছে পার্বতীপুর থেকে মালামাল বিক্রি করে ক্লান্ত শরীরে রাত ১১টায় ট্রেনে উঠেই ঘুমিয়ে গেছি। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি আমি কাউনিয়া স্টেশনে। কি আর করা, অগত্যা ব্যাগে থাকা বই নিয়ে প্লাটফর্মের লাইটের আলোতে পড়া শুরু করি। পাশাপাশি ব্যাগে থাকা যন্ত্রাংশ আগলে রাখি। ভোরবেলা অন্য ট্রেনে রংপুর ফিরি। আবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে ১০টার দিকে ব্যাগে যন্ত্রাংশ ও বই নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এভাবে নির্ঘুম রাত, বিশ্রামহীন দিন গেছে পার্টস ফেরি করে বিক্রি করতে আমার। 

তিনি বলেন, আমার পিঠের ব্যাগে পার্টস ছাড়াও ক্লাসের নির্দিষ্ট বই ছিল। সময় পেলেই রাস্তায়, ট্রেনে, দোকানে, পড়ালেখা করেছি। দশম শ্রেণিতে ১৮৪ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ১ম স্থান অধিকার করি। এরপর সেখান থেকে এসএসসি এবং রংপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। পাশাপাশি চলতে থাকে ফেরি করে পার্টস বিক্রি করা। 

তৌহিদ হোসেন জানান, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যবসায় সময় দিতে গিয়ে আমার খাওয়ার কোন শিডিউল ছিল না। যা খেতাম তা বমি হয়ে যেতো। তারপর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তারা বলেন, আমার আলসার হয়েছে, যা মরণব্যাধি ক্যান্সারে পরিণত হওয়ার শঙ্কা ছিল। চিকিৎসকরা পাকস্থলী থেকে দুটি পলিপ অপসারণ করে ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য পাঠায়। ৭ দিন পর রিপোর্ট আসার কথা। ওই ৭ দিন প্রতিটি মুহূর্ত ছিল একেক বছরের সমান। শুধুই কাঁদতাম আর ভাবতাম ক্যান্সার হয়, তাহলে আমার এত পরিশ্রমের লালিত স্বপ্নের কি হবে। তখন মৃত্যুটাকে খুব সহজ মনে হলো আমার কাছে। এরপর রিপোর্ট ভালো আসা মাত্র নামাজ শুরু করি, আজীবন যেন পড়তে পারি সেই প্রতিজ্ঞা করি।

তিনি বলেন,  আমি মনে করি ইচ্ছের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম এবং সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে চেষ্টা করলে সফলকাম হওয়া যায়। যা আমি আল্লাহর রহমতে করতে সক্ষম হয়েছি। আমার ইচ্ছা দেশের তরুণ সমাজ শুধু চাকরির চেষ্টা না করুক। তারা ব্যবসার চিন্তাও করুক। আমার ইচ্ছা কর্মসংস্থান সৃষ্টির।

কেকে/এইচএস
আরও সংবাদ   বিষয়:  রংপুর   তৌহিদ   প্রেরণা   উৎস   
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন নিয়ে সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ২
কুমিল্লায় নির্বাহী প্রকৌশলীর গাড়ি চুরির সময় যুবক আটক
হামাসের সামরিক প্রধান দেইফের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করল হামাস
আক্কেলপুরে নারী ফুটবল ম্যাচের আগে ভাঙচুরের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন
সমন্বয়ক আখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেসে ঢুকে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হামলা, আহত ৮

সর্বাধিক পঠিত

কুবি শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে লিখিত অভিযোগ
থাই গেম ও ভিসা প্রতারকদের গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন
নামাজ থেকে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ ইউপি সদস্য, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ
চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু, ডাক্তারের নামের পাশে ভুয়া পদবি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জিলানীর কুল বাগান উদ্বোধন

গ্রামবাংলা- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝