চায়ের রাজ্যখ্যাত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহরের প্রধান সড়ক চৌমুহনা চত্ত্বর এলাকায় এখন চড়ুই পাখিদের কলরবে মুখর। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন বিকেল হলেই এ চত্ত্বরটির পূর্বদিকে কলেজ রোডের প্রারম্ভ প্রান্তে অবস্থিত বৈদ্যুতিক খুটি থেকে পশ্চিম দিকে হবিগঞ্জ রোডের প্রারম্ভ প্রান্তে অবস্থিত অপর একটি বৈদ্যুতিক খুটি পর্যন্ত বিদ্যুতের লাইন, ডিসলাইন, ইন্টারনেট লাইনসহ বিভিন্ন তারে সারি বেঁধে বসে থাকে হাজার-হাজার চড়ুই পাখি।
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দ, দল বেঁধে তারে বসা, ফুড়ৎ ফুড়ৎ আসা-যাওয়া, এক তার থেকে আরেক তারে উড়াউড়ি মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে এলাকার মানুষের মাঝে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আর মনোরম কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
পাখির ঝাঁক দেখতে আর কিচিরমিচির শব্দ নজর কাড়ছে পথচারীদের। সারারাত ধরে চলে এলাকাটিতে হাজারো চড়ুই পাখিদের আনাগোনা। রাত যত বাড়ে চড়ুই পাখিদের সংখ্যা ততই বাড়তে থাকে। ব্যস্ততম চৌমুহনা চত্ত্বরে রাত কাটিয়ে ভোরে খাবারের সন্ধানে চড়ুই পাখিরা উড়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে।
সিএনজি অটোরিকশা চালক মো. শফিক মিয়া বলেন, প্রায় চার বছর পূর্বে চৌমুহনার ওই কারেন্টের তারে কয়েকটি পাখি বসা শুরু করে। ধীরে ধীরে এখানে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। কোন মানুষ এসব পাখিদের কোন ক্ষতি করেন না। এখন এখানে হাজারো পাখির মেলা। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মন ভরে যায়। মূল শহরে এ ধরণের পাখিদের বসবাস বর্তমান সময়ে বিরল।
ইত্যাদি স্টেশনারী ও সংবাদপত্র এজেন্ট গৌতম দাশ বলেন, প্রতিদিন বিকেল বেলা যখন পাখিগুলো চৌমুহনা এলাকায় আনে তখন মনে হয় পাখিদের মেলা বসেছে। অনেকে পাখি দেখতে এখানে আসেন। বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীরা পাখিদের ডাকাডাকিতে যানবাহনের গ্লাস খুলে পাখিদের এক নজর দেখে যান।
শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আশিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, একসঙ্গে হাজার হাজার চড়ুই পাখি আগে দেখা গেলেও এখন সাধারণত দেখা মেলে না। তবে শীত মৌসুমে শ্রীমঙ্গল চৌমুহনা সড়ক চড়ুই পাখিদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। বিকেলের দিকে পাখিগুলো যখন আসে, তখন খুব সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এ স্থানটিতে তারা নিরাপদে থাকতে পারছে। কেউ পাখিদের বিরক্ত করে না। তাই দীর্ঘদিন ধরে এসব পাখি এখানে অবস্থান নিয়ে রাত্রিযাপন করে।
দৈনিক ইনকিলাব শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন জসিম খোলা কাগজকে বলেন, চড়ুই পাখিরা কয়েক বছর যাবত শ্রীমঙ্গল শহরের মেইন রোডের দুপাশের বৈদ্যুতিক তারে আশ্রয়স্থল গড়ে তুলেছে। যেন কত প্রশান্তির নীড় তাদের। সন্ধা থেকে চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চৌমুহনা এলাকা। নীড়ে ফিরে ক্ষণিকের জন্য তারা যেন খুনসুটিতেও মেতে ওঠে। অবাক বিস্ময়ে পথিকরা তাকিয়ে দেখেন প্রকৃতির সৌন্দর্য এই ছোট্ট-চঞ্চল পাখির উড়া-উড়ি, নাচা-নাচি। উপভোগ করেন কোলাহলমুখর এ পরিবেশ। আহা! কী নির্মল আনন্দ। এ আনন্দ, এ কোলাহল পাখিপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মুহূর্তের জন্যেও হলেও মনটা ভরে ওঠে প্রশান্তিতে। এখানে কেউ পাখি শিকার বা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে পারে না। বিদ্যুতের তারে তারে গায়ে গায়ে বসে থাকে অগণিত চড়ুই পাখি। যানবাহনের অস্বাভাবিক শব্দও সয়ে গেছে তারা।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সূত্র মতে, শ্রীমঙ্গল চৌমুহনা এলাকায় আবাস গড়ে তোলা পাখিকে পাতি চড়ুই পাখি বলা হয়। এ প্রজাতির পাখির বৈজ্ঞানিক নাম প্যাসারিডি। যার অর্থ গৃহবাসী চড়ুই। এ ধরণের চড়ুই পাখি সাধারণত দৈর্ঘ্যে ১৬ সেমি (৬ দশমিক ৩ ইঞ্চি) এবং ওজন ২৪ থেকে ৩৯ দশমিক ৫ গ্রাম হয়ে থাকে। এদের প্রধান খাবার বীজ ও শস্যদানা। মানববসতির আশেপাশে সহসাই পাতি চড়ুইয়ের দেখা পাওয়া যায়। প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা এ প্রজাতির পাখির। তবে সাধারণত জনহীন বনভূমি ও মরুভূমিতে এরা বসবাস করে না।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, চড়ুই পাখি আমাদের অত্যন্ত নিকটতম বা প্রতিবেশী পাখি। গ্রামগঞ্জে অত্যন্ত ছোটবেলা থেকে যে পাখির ডাক শুনে আমরা বড় হয়েছি সে পাখি হলো চড়ুই। এ পাখিটি আমাদের পারিবারিক খাবার ও শস্য খেয়ে থাকে। প্রকৃতির প্রয়োজনে আমাদের উচিত পাতি চড়ুইয়ের যত্ন নেওয়া।
কেকে/এএম