হাতির সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করেছে । বনবিভাগের অবহেলা ও বনকে পর্যটকখাতে উন্নয়ন করার কারণে হাতি চলাচলের পথ, খাদ্য স্থান কমার ফলে দিন দিন হাতি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দূর্বল অস্থায় বনে মরে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ঠিক তেমনি কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের টেকনাফ রেঞ্জেই ১৩দিনে ২টি হাতি মারা গেছে। একটি গত ৫জানুয়ারি বাচ্চা প্রসবের সময় টেকনাফের হোয়াইক্যং বনবিটে একটি মা হাতির মৃত্যু হয় এবং আরেকটি গত শনিবার (১৮ জানুয়ারি) হ্নীলা বিটের পাহাড়ি ছড়া মৃত হাতির সন্ধান পাওয়া যায় পরে তা পোষ্ট মর্টেম করে মাটিতে পুতে ফেলা হয় বলে জানা যায়। এ ছাড়া গত বছরের ১৬ আগস্ট উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নে নোয়াখালীপাড়ায় বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি বন্য হাতির মৃত্যু হয়। এভাবে হাতি শূন্য হতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
এই মাসের ১৩ দিনের মাথায় দুই হাতির মুত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
বনবিভাগ সূত্রে পাওয়া গেছে, গত শনিবার সকালে হ্নীলা বিটের পাহাড়ি ছড়ায় বনকর্মীরা একটি হাতির মরদেহ পড়ে থাকার খবর পেয়ে সেখানে যান। স্ত্রী জাতের এই হাতির বয়স আনুমানিক ১৫ বছরের মতো। তবে কেন মারা গেছে এখনো জানা যায়নি। হাতিটি বেশ দূর্বল হয়েঘিল বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং হাতিটি পানি পান করতে ছড়ায় নামতে পারে বলে জানান বনবিভাগ।
মৃত হাতির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই জানিয়ে বন বিভাগের টেকনাফের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ বলেন, ধারণা করা হচ্ছে পাহাড়ের চূড়া থেকে দু-এক দিন আগে পড়ে গিয়ে হাতিটি মারা গেছে। ময়নাতদন্ত শেষে হাতিটি মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
অন্যদিকে গত ৫ জানুয়ারী বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে আরেকটি মা হাতি মারা যান। বনবিভাগ বলছে বাচ্চা প্রসবকালিন সময় জরায়ু বের হয়ে যাওয়ার কারণে মা হাতিটির মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে প্রকৃতি বিধ্বংসী কর্মকান্ডে দেশে হাতির আবাস্থল হুমকির মুখে পড়ার কারণে এভাবে হাতির মৃত্যু হচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীর। কিছুদিন আগে উখিয়াতে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে হাতির একটি পাল। উখিয়া রেঞ্জ সেই হাতিগুলোকে নিরাপদে পাশ্বর্বতী পাহাড়ে তুলে দিয়েছে। গত এক দশকে বিভিন্ন জেলার বনাঞ্চলে হাতি বিচরণ আয়তন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক খাবার সংকট। যুগযুগ ধরে একের পর এক বন্যপশু চলাচলের পথে সড়ক, রেলপথ ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশবাদীদের কঠোর আপত্তি ছিল উপেক্ষিত। হাতির বিচরণ আছে এমন এলাকাগুলোতে প্রাকৃতিক অনেক ঝিরি-ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। এতে বাধ্য হয়ে খাবার ও পানির সন্ধানে লোকালয়ে ঢুকছে বন্যহাতী। দেশে বাঘ রক্ষায় বন অধিদফতরে বহুমুখি কার্যক্রম থাকলেও প্রোবোসিডিয়া বর্গের একমাত্র জীবিত বংশধর ‘হাতি’ রক্ষায় ঢিলেঢালা ভাব রয়েছে। এখন বছরে একদিন ‘বিশ্ব হাতি দিবসে’ সভা-সেমিনারে সীমিত হয়ে পড়েছে হাতি রক্ষার হাকডাক। বনভূমি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন অধিদফতরের অক্ষমতা এবং পর নির্ভর জরিপে কাগজে কলমে দেশে বেঁচে থাকা ২৬৮টি হাতির সংখ্যা বিশ্বাস না করলেও করতে হবে।
২০১৭ সালে বন বিভাগ এবং আইইউসিএনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আবাসিক হাতির বিচরণ বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। দেশের বনাঞ্চলে আবাসিক বন্যহাতি আছে ২৬৮টি। এ ছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী পাঁচটি বনাঞ্চলে ৯৩ থেকে ১০৭টি পরিযায়ী হাতি বিচরণ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ৯টি বিভাগীয় বন অফিসের আওতায় হাতি চলাচলের ১১টি রূট চিহ্নিত করা হয়েছিল, যার দৈর্ঘ্য ১৫১৮ কিলোমিটার। গত ছয় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের তিনটি করিডোর। কক্সবাজার উখিয়া ও টেকনাফ পাহাড়ি বনাঞ্চলে কয়েকটি হাতি চলাচলের করিডোর ছিল। তবে ২০১৭ সালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে উজাড় হয়েছে ৬ হাজার একর বনভূমি। এতে উখিয়া ও টেকনাফে হাতি চলাচলের অধিকাংশ করিডোর বন্ধ হয়েছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতির জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবিদরা। রেলপথটি বন্যহাতির অন্যতম তিন বিচরণক্ষেত্র চুনতি, ফাসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর। এতে হাতি চলাচলের ২১টি পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। কক্সবাজারে গত তিন বছরে প্রাণ গেছে সাতটি বন্যহাতির। রোহিঙ্গা বসতিতে হাতির আক্রমণে কয়েকজন রোহিঙ্গা মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
অনুসন্ধান বলছে, বন অধিদফতরের কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণে বিভাগীয় দফতরগুলো অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তবে একদিকে উচ্ছেদ অন্যদিকে ফের দখল হওয়ায় সরকারি অর্থ ও কর্মঘন্টা অপচয় হচ্ছে। কক্সবাজারে পাহাড় ন্যাড়া করে লেবু চাষের হিড়িক পড়েছে। কৌশলে হাতি চলাচলের পথগুলোতে কাটাযুক্ত লেবুবাগান গড়ে তুলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বন্ধ করতে মরিয়া বন দখলকারীরা। এতে হাতি চলাচলের দীর্ঘদিনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার রামু উপজেলায় কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের রোয়ারঘোনা এলাকায় সাইফুল বনভূমি দখল করে লেবু বাগান গড়ে তুলেছে। অতীতে সেখানে হাতি দেখা যেত বলে স্থানীয়দের অভিমত। এ ছাড়া কক্সবাজার রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জে নজির আলমের মতো আরও অনেকে বনভূমি দখল করে লেবু বাগান গড়ে তুলেছেন। ফলে বিচরণ আয়তন সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি চলাচলের পথগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকালয়ে প্রবেশ করছে হাতি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা কক্সবাজার কমিটির সভাপতি এইচ এম এরশাদজানান, দিনদিন হাতির করিডোর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে হাতি চলাচল করতে পারছে না। যার কারণে হাতির খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। দিন দিন হাতিগুরো দূর্বল হয়ে পড়ছে । বনবিবাগের উচিৎ হাতির করিডোর যা বন্ধ হয়েছে বা হাতি চলাচলের যেকানে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা খোজে সমাধান করা বা হাতির নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা করা । অন্যথায় হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক মনিরুল ইসরাম জানান, সম্প্রতি আসলে এমনভাবে হাতির মৃত্যু হলে আমরা যারা বনবিভাগে আছি আমরাও সঙ্কিত। হাতি চলার করিডোর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে রামুতে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প করার পর থেকে হাতির চলার ফথ অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে সেনাবাহিনী বনের অনেক বড় জায়গা দখল করে রয়েছে। একটি হাতি ৮৫ কিলোমিটার হাটে দৈনিক। হাতির জায়গায় মানুষ ডুকে পড়েছে। যার কারণে হাতির চলার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও দেশের নাগরিক হিসাবে এটা নিয়ে চিন্তিত এবং সঙ্কিত মনে করছি আগামীতে আমরা কিভাবে হাতি রক্ষা করবো।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম জানান, দুটি হাতি মারা গেছে তা আমি অবগত আছি। গত শনিবার যে হাতিটি মারা গেছে তা কেন মারা গেছে এখনো জানা ডায়নি তবে হাতির গায়ে কোন মারাত্বক চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে পানি পা করতে গিয়ে আহত মারা গেছে।
কেকে/এআর