দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত বিনোদনমূলক ও ক্রীড়াবিষয়ক কার্যক্রমে বাধা এবং ভুল করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব কর্মকা- ‘তাওহিদী জনতা’ নামে একটি ব্যানারে ঘটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ।

বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, এসব কর্মকান্ডের পেছনে আদতে কারা রয়েছেন? তারা কি সত্যিই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার জন্য কাজ করছেন, নাকি পরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন? অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে মৌলবাদী ও ইসলামী চরমপন্থার শিকার দেশ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য একটি বিশেষ চক্র পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।

গত বুধবার জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের কথা ছিল। তবে মাঠটি ঘিরে রাখা টিনের বেড়া ভাঙচুর করা হয়, যার ফলে ম্যাচটি বাতিল করতে বাধ্য হন আয়োজকরা। এর আগের দিন মঙ্গলবার দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বাউনা গ্রামেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সেখানে নারীদের একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজিত হওয়ার কথা থাকলেও, কিছু লোক এসে বাধা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি বাতিল করতে হয়।

অপরদিকে নারীদের বিনোদনমূলক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার এ ধারা শুধু ক্রীড়াঙ্গনে সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি নতুন রেস্তোরাঁ উদ্বোধনের কথা ছিল জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসের। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ ফেসবুকে প্রচারণা চালায়। কিন্তু অপু বিশ্বাসের উদ্বোধনে অংশ নেওয়ার খবরে স্থানীয় কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তি জানান এবং প্রতিবাদ করেন। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে ঘটনাটি কামরাঙ্গীরচর থানা পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ অপু বিশ্বাসকে দিয়ে উদ্বোধনের পরিকল্পনা বাতিল করে। এর আগে চিত্রনায়িকা পরীমনিও একই ঘটনার শিকার হন।

এ ধরনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব কর্মকা- পরিকল্পিত নাশকতা নাকি ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে চরমপন্থি মনোভাব বিস্তারের চেষ্টা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেউ কেউ বলছেন, এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারীদের অংশগ্রহণ ও স্বাধীনতা সংকুচিত করার অপচেষ্টা চলছে। আবার অনেকে মনে করেন, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্য করতে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। তারা মনে করছেন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ভূমিকাই পারে এসব কর্মকান্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচন করতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে।

এদিকে এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য রফিকুল ইসলাম খোলা কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি দেশ; যেখানে নানা কৃষ্টি-কালচারের মানুষ বসবাস করছে। এখানে বিভিন্ন মত-পথ ও সংস্কৃতি রয়েছে। সবাই স্বাধীনভাবে তাদের সংস্কৃতি পালন করবে। এখানে বাধা প্রদান কিংবা অসদাচরণ করা যাবে না। বিশেষ করে বিনোদনমূলক ও ক্রীড়াবিষয়ক কার্যক্রমে বাধা দিয়ে ভুল করে দেওয়া বা যে বাতিলের ঘটনা ঘটেছে আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি।’

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নিন্দা: এ ঘটনায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন গত বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘটনার নিন্দা ও প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বাফুফে বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছে, বাফুফে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে টিনের বেড়া ভাঙচুরের ঘটনাকে সমর্থন করে না। ফুটবল সবার জন্য। নারী ফুটবলারদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। নারীদের খেলাধুলায় বাধা সৃষ্টি ক্রীড়া উন্নয়ন ও অগ্রগতির পরিপন্থি। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। নারীদের ফুটবল খেলায় যেন কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করা হোক। একই সঙ্গে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিত্বদের নারীদের ক্রীড়াচর্চায় সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

নিন্দা জানাল অন্তর্বর্তী সরকার: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নারীদের বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকা-ে কয়েকটি বাধা প্রদানের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিবৃতি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি মেয়েদের দুটি ফুটবল ম্যাচ পরিচালনার ক্ষেত্রে যারা বাধা দিয়েছে, তাদের এই কর্মকাণ্ডে নিন্দা জানায় সরকার।

বিবৃতিতে বলা হয়, নারীরা বাংলাদেশের নাগরিক এবং পুরুষদের মতোই সমানভাবে মানবিক ও নাগরিক অধিকার ভোগ করে। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেউ নারীদের অধিকার লঙ্ঘন করার মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত হলে বা এ ধরনের বেআইনি বিধিনিষেধ আরোপের সঙ্গে যুক্ত হলে তিনি বা তারা দেশের প্রচলিত আইনে যথাযথ ব্যবস্থার মধ্যে পড়বেন বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার যে কোনো গোষ্ঠীর নাগরিকদের প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়নের যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ইতোমধ্যে দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলা প্রশাসনকে স্থগিত ফুটবল ম্যাচ পুনরায় চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। জেলা প্রশাসকেরা জানিয়েছেন, তারা সম্প্রতি তাদের জেলায় নারীদের ফুটবল, ক্রিকেট ও কাবাডি ম্যাচ আয়োজন করেছেন। শত শত মানুষ ম্যাচগুলো উপভোগ করেছেন এবং তাদের জেলার সব শ্রেণির মানুষ এসব আয়োজনের প্রশংসা করেছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, গত এক মাসে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বৃহত্তম যুব উৎসবগুলোর মধ্যে একটি আয়োজন করেছে, যার মধ্যে জেলা ও উপজেলা শহরে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নারী খেলোয়াড়দের জন্য নানা ইভেন্ট অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেক প্রত্যন্ত গ্রামীণ জেলায়ও হাজার হাজার মেয়ে ফুটবল, ক্রিকেট ও কাবাডি ম্যাচে অংশ নিয়েছিল।

বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক ইউনূস আজীবন নারী অধিকারের পক্ষের একজন। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ৯০ শতাংশেরও বেশি মালিকানা ছিল নারীদের। গত সপ্তাহে অধ্যাপক ইউনূস ফিফার প্রধান জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গে দেখা করেন এবং বাংলাদেশে নারী ফুটবলারদের জন্য অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা তৈরিতে তার সহায়তা চান।

কেকে/এআর