বিষপাতা জেনেও বেশি লাভের আশায় তামাক চাষ দিন দিন বেড়েই চলছে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু তামাক ছাড়া অন্য কিছু ফসল দেখা যায়না। তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানীর লোভনীয় অফার এবং কৃষকদের বিনামূল্যে তামাকের বীজ, সারসহ, বিনা সুদে ঋণ দেওয়া ও অধিক লাভজনক হওয়ায় তামাক চাষে এ অঞ্চলের কৃষকরা বেশি ঝুঁকে পড়ছে।
কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় জেলার চাষিরা তামাক বেশি বেশি করে চাষ করছেন। তারা ধান, গম বা ভুট্টা চাষ কমিয়ে তামাক চাষের প্রতি বেশি ঝুঁকছেন। বর্তমানে চাষিরা তামাকের ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় তামাকের কাজ করছেন নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, ঢাকা টোব্যাকো, জাপান টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, নাসির টোব্যাকো, আকিজ টোব্যাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি বীজ, সার তামাক উৎপাদনের আগেই কোম্পানিগুলোর বিক্রির নিশ্চয়তা, দর নির্ধারণ ও অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তামাক চাষে চাষিদের আগ্রহী করে তুলছে। এ কারণে তামাক চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর কাজে আসছে না কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শ।
আর তামাক নামক বিষপাতা চাষের জেলা হিসেবে শীর্ষস্থানে রয়েছে লালমনিরহাট জেলা। গত বছরের তুলনায় এ বছর এই বিষপাতার চাষ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, সেই সাথে কমছে জমির উর্বরতা এবং বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে নানা প্রণোদনা, প্রদর্শণী দেওয়া হলেও তামাক কোম্পানির লোভনীয় আশ্বাসের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, কৃষকদের তামাক চাষের কুফলগুলো বোঝানোর পাশাপাশি অন্যান্য ফসল চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, তামাকজাত কোম্পানির প্রলোভনে ও অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন এ অঞ্চলের কৃষকেরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েক বছর আগেও লালমনিরহাটের যেসব এলাকায় আবাদি জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ও আলুসহ বিভিন্ন আগাম জাতের সবজি চাষ করা হতো, সেসব জমিতে এখন তামাক চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলাসহ তিস্তা নদীর প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের জমিগুলোতে দিন দিন তামাক চাষ বেড়েই চলেছে । এসব তামাকের জমিতে বড়দের পাশাপাশি শিশুদের দিয়ে চলছে পরিচর্যার কাজ। তামাক সুতলীর মধ্যে গেথেঁ চলাচলের রাস্তা-ঘাটসহ যেখানে সেখানে টাঙ্গিয়ে শুকাচ্ছে, এতে রাস্তায় চলাচল মানুষের তামাকের বিষাক্ত ঘ্রাণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
কৃষকরা জানান, লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে আদিতমারী উপজেলায় তামাকের চাষ বেশি হয়। আর এর কারণ, অন্যান্য ফসল চাষ করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং শ্রমিকের অধিক মূল্য হওয়ায় তারা প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে অধিক মুনাফার আশায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি জেনেও তারা তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছে। তারা আরো বলেন, সিগারেট কোম্পানির মাধ্যমে তামাক চাষীদের জন্য একর প্রতি জমিতে বিজ ও নগদ টাকা দেয়া হয়। সেই সঙ্গে ইসুবি সারের জন্য টাকা, সার আগাম দেওয়া হয়।
আদিতমারী উপজেলার বসিনটারী এলাকার তামাক চাষি মিলন মিয়া জানান, তামাক বিষ ও ক্ষতিকারক জেনেও এ বছর এক বিঘা জমিতে এ বছর তামাক চাষ করা হয়েছে। তামাক চাষ একটি লাভজনক ফসল, একবারে মোটা অংকের টাকা পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানী অগ্রিম হিসেবে বীজ ও সার দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে যা পরবর্তীতে তামাক তাদের নিকট বিক্রি করলে তখন টাকা কেটে নেয়।
একই এলাকার আরেক কৃষক আব্দুস সামাদ জানান, তামাক চাষ যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকে তামাক চাষ করে থাকি। অন্যান্য ফসলের চেয়ে তামাকজাত একটি লাভজনক ফসল। তাছাড়া তামাক চাষ করে পরে ধান চাষ করলে ফলন বেশি হয়। এই জন্য প্রতি বছর তামাক চাষ করে থাকি। ২৭ শতক জমিতে খরচ হয় ১২ হাজার আর বিক্রি হবে প্রায় ৩৬ হাজার।
সারপুকুর মিলন বাজার এলাকার কৃষক মমতাজ জানান, অন্যান্য ফসল চাষ করলে ঝুঁকি থাকে দাম পাওয়া যায়না। আর তামাক চাষ ক্ষতিকারক জেনেও প্রতি বছর চাষ করে থাকি। এটি চাষ করলে ঝুঁকি থাকে না। অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। একবারে মোটা অংকের টাকা পাওয়া যায় বিধায় চাষ করি।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন নির্মলেন্দু রায় বলেন, তামাক চাষ ও সেবনে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক পাতার বিড়ি, সিগারেট, গুল, খইনি ও জর্দাসহ নানান ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করায় বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, স্টক, চর্ম, যৌন, ক্যান্সারসহ নানা রোগ। তামাক চাষের কারণে কৃষকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন শিশুসহ, সাধারণ মানুষ।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোঃ সাইখুল আরিফিন বলেন, এবছর লালমনিরহাট জেলার ৫ উপজেলায় মোট ১৫ হাজার ৫৭ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। যা গতবছরের তুলনায় ৯ হাজার ৮ শত ৬৫ হেক্টরের বেশি জমিতে তামাক চাষ বেশি হয়েছে ।
তিনি বলেন, কৃষি জমি এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য তামাক চাষ মারাত্মক ক্ষতিকর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা সেমিনার ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে কৃষকদের তামাক চাষের প্রতি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের বিনামূল্যে তামাকের বীজ, সারসহ, বিনা সুদে ঋণ দেওয়া ও অধিক লাভজনক হওয়ায় কোন পরামর্শই কাজে আসছে না । যে কারণে তামাক চাষে আগ্রহী বেশি হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকরা বলে তিনি দাবী করেন।
কেকে/এইচএস