বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে উঠেছে খেলাপী ঋণ। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের অন্যতম আর্থিক প্রতিষ্ঠান পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনায় অসংগতি ও খেলাপী ঋণের ঊর্ধ্বগতি গ্রামীণ আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০০৯ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ নামে বিশেষ প্রকল্প চালু করেন। যার লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিক স্বাবলম্বী করা। পরবর্তীতে সেটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’। ২০১৪ সালে প্রকল্পটি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। এ ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় এনে আর্থিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কিন্তু পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের যাত্রার ১ দশকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ঘেরাকলে ঝুঁকিতে আমানতকারীদের অর্থ। ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা না থাকায় প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে খেলাপীর পরিমাণ।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হবিগঞ্জ শাখায় বর্তমানে মোট অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ ১১৯ কোটি ৪৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫১ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার টাকা খেলাপী ঋণের আওতায় পড়েছে, যা মোট ঋণের ৪৩ শতাংশ। শাখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপী ঋণের পরিমাণ বাহুবল ও আজমিরীগঞ্জে।
অন্যদিকে, মাধবপুর ও হবিগঞ্জ সদর শাখায় খেলাপীর পরিমাণ তুলনামূলক কম। খেলাপী ঋণের এই ঊর্ধ্বগতির ফলে ব্যাংকটির আয় এবং সেবার মান উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিজ নিজ এলাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তারা নিকট আত্মীয়, বন্ধু বা পরিচিতজনদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে কর্মকর্তা থেকে মাঠকর্মী সবার বিরুদ্ধে। এছাড়া, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য প্রদত্ত ঋণ অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত যাচাই ছাড়াই বিতরণ করা হয়েছে। এতে ঋণের অর্থ নির্ধারিত উদ্দেশ্যে ব্যবহার না হয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খরচ হয়েছে। ফলস্বরূপ, ঋণগ্রহীতারা নিয়মিত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।
ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকরা অনিয়ম-দূর্নীতির সাথে জড়িত থাকায় দীর্ঘদিনের খেলাপী ঋণ উত্তোলনে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তারা। এমনকি খেলাপী গ্রাহকের বিরুদ্ধে করা হয়নি মামলাও। আইনজীবি নিয়োগ দেওয়ার ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও নেওয়া হয়নি কোনো ধরণের আইনি সহযোগিতা।
ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত ব্যাংকটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্প হওয়ায় কেউ সঠিকভাবে তদারকি করেনি। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিজেদের ইচ্ছে মতো যাকে খুশি ঋণ দিয়েছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন ধরণের নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। এক প্রকল্পের ঋণ আরেক প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকটিতে আমানতকারিদের অর্থ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের হবিগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক দেবাশীষ রঞ্জন রায় বলেন, ব্যাংকে কোন ধরণে অনিয় হয়নি। মাঠকর্মীরা নিজ ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করায় তারা কিছুটা স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন। তবে এখন তাদেরকে নিজ ইউনিয়ন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে ব্যাংকের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
এছাড়া খেলাপী ঋণ উত্তোলনের জন্য ইতোমধ্যে ৩ জন আইনজীবি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (সিলেট বিভাগ) এএসএম নাহিদ আলীম বলেন, প্রথম অবস্থায় ঋণ বিতরণে কিছু অনিয়ম হয়েছে। সঠিকভাবে যাচাই বাছাই না করে ঋণ দেওয়ার ফলে খেলাপী পড়েছে। তবে এখন সেগুলো ঠিক করা হচ্ছে। খেলাপী ঋণ উত্তোলনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।। এছাড়া নতুনভাবে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ভালোভাবে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
ব্যাংকটির খেলাপী ঋণ উত্তোলনে সহযোগিতা করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবি অ্যাডভোকেট মহিবুর রহমান বাহার।
তিনি বলেন, আমাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা আমাদের কোনো সহযোগিতা নেয়নি। আমাদের নিয়ে কোনো সভা-সেমিনার করেনি। এছাড়া খেলাপীপ্রাপ্তদের কোনো তালিকাও আমাদেরকে তারা দেয়নি। কেন দেয়নি সেটি বলতে পারব না। তারা যখনই আমাদের ডাকবে, আমরা তাদেরকে আইনি সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
কেকে/এএম