একদিকে পাহাড় অন্যদিকে বালিয়াড়ি দেখতে পৃথিবীর সেরা সুন্দর জায়গারটির নাম মেরিন ড্রাইভ সড়ক। সেই সড়কের পাশে হিমছড়ি প্যাচারদ্বীপ এলাকায় বিশাল সৈকত বালিয়াড়ি এলাকা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মারমেইড বিচ রিসোর্ট।
সম্প্রতি বালিয়াড়ি দখলমুক্ত অভিযান পরিচালনা চলমান থাকলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে এই মারমেইড বিট রিসোর্টে অভিযান পরিচালনা করা হলেও তা পরে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অভিযানের পর কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ মারমেইড বিচ রিসোর্টের বিরোদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। বনবিভাগ মামলা করার কারণে স্থানীয় হিমছড়ি বিট কর্মকর্তা কামরুজ্জামান শোভনকে বিভিন্ন মাধ্যমে হয়রানি করার চেষ্টা করেন বলে জানা গেছে।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার পেঁচারদ্বীপ সৈকতের বালুচরের উপর নির্মিত অন্তত ৫ একর এলাকার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল গত মাসের ২১ তারিখ। দিনব্যাপি অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করা হলেও আবারো সেই স্থাপনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে মারমেইড বীচ রিসোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরোদ্ধে। বালিয়াড়িতে স্থাপনা গড়ে সেখানে করা হয়েছে ফুল মুন পার্টি। অভিযানকালিন কাঠের সেতু ভাঙ্গা হলেও আবারো কাঠের সাঁকোটি মেরামত করে চালু করা হয়েছে বালিযাড়িতে থাকা রিসোর্টগুলো।
রামু উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি সাজ্জাদ জাহিদ রাতুল জানান, গতমাসে এই অভিযান পরিচালনা করা হলেও আবারো স্থাপনা তৈরি করা হযেছে কিনা তা জানা নেই। এদিকে গত ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে প্রায় ২০ একর জমি জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হলেও তৎকালিন সময়ের কিছু এমপি-মন্ত্রীদের দাপট দেখিয়ে আবারো সেই জমি দখলে নিয়ে তৈরি করেছে মারমেইড রেস্তোরা।
এখন প্রায় শত একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই মারমেবডি বিচ রিসোর্টটি।এদিকে রিসোর্টের এরাকা বাড়াতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে দরিয়ানগর সৈকতের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক খাল ভরাট করে রেস্তোরাঁ তৈরির চেষ্টা চলছিল বেশকিছুদিন আগে থেকেই।রিসোর্টটির মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগ।
অভিযোগ উঠেছে, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী পলকসহ একাধিক মন্ত্রী-প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সম্পর্কের বলয় দেখিয়ে একের পর এক সমুদ্র্রের বালিয়াড়ি দখল করেছেন সোহাগ। নিজেকে শেখ পরিবারের একজন দাবি করা সোহাগ দখলবাজি চালিয়ে গেলেও অজানা কারণে গত ১৫ বছর প্রশাসনের কেউ সেদিকে নজর দেননি। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রশাসনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বহমান খালের ওপর অবৈধ একটি সেতু নির্মাণ করেছেনযে সেতুর ওপর দিয়ে যেতে হবে সেই বিশেষ ডিজে ও মদের জোনে। তবে সেতুর কারণে খালে নৌকা চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। পর্যটনের দোহাই দিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড চললেও প্রশাসনের নিশ্চুপতায় প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় লোকজনের মনে।
অভিযোগ রয়েছে কক্সবাজারে কোনো ভিআইপি আসলে এই রিসোর্টে আথিতিয়তা গ্রহণ করে অনেকেই। রিসোর্টের মালিক সোহাগ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন উর্দ্ধতন কর্মকর্তার নাম দিয়ে বেশ বিশাল বালিয়াড়ি দখল করে সমুদ্র সৈকতে গড়ে তুলেছে বিশাল সাম্রাজ্য। এই বালিয়াড়ি যেন তার নিজস্ব সম্পদ এমনভাবে ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে।
নামমাত্র কিছু জায়গা মারমেইড বিচ রিসোর্চের নামে থাকলেও তার বেশ কয়েকগুন অবৈধ দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে সরকার যেমন হারিয়েছে জমি তেমনই পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে বলে জানা সমাজের সচেতন নাগরিকরা।
বর্তমানে পর্যটন মৌসুম হওয়ার কারণে এখন প্রতিষ্ঠানটি ডিজে ও মদের পার্টির জন্য বিশেষ জোন তৈরি করেছে ঝাউবীথির বাগানে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফুল মুন বিচ পার্টি’। এটা করতে গিয়ে কাটা পড়েছে শত শত ঝাউগাছ। উপড়ে ফেলা হয়েছে সমুদ্রসৈকত রক্ষায় রোপণ করা ঝাউবীথি। যার ফলে পরিবেশের পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশের একমাত্র মেরিন ড্রাইভ সড়ক।
হিমছড়ির একটি ট্রলারের মাঝি রফিকুল ইসলাম বলেন, এ খাল দিয়েই স্থানীয় লোকজন ছোট ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ শিকারে বের হতো। খালের ওপর সেতু নির্মাণ করায় সেতুর নিচ দিয়ে ট্রলার চালানো যাচ্ছে না। ফলে অনেকে তাদের মাছ ধরার ট্রলার বিক্রি করে দিয়েছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে মারমেইড রিসোর্টে দেখা যায়, পর্যটক বা স্থানীয় লোকজন নির্মিত সেতু দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। পরে বিশেষ টোকেনহাতে দেওয়ার পর প্রবেশ করতে পারেন পর্যটকরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কৌশলে একজনকে ম্যানেজ করে সেই সেতু দিয়ে বিশেষ জোনে। সেখানে গিয়ে দেখা মিলে শত শত ঝাউবীথি কেটে তৈরি করা হয়েছে নাচ-গানের মঞ্চ, কফিশপ, মদের বারসদৃশ্য বিশেষ জোন। এটি মূলত সমুদ্রে গজিয়ে ওঠা চর। জায়গাটিতে ঝাউবীথি রোপণ করেছিল উপকূলীয় বন বিভাগ, যেগুলো কেটে স্থাপনা তৈরি করেছে মারমেইড।
প্রবেশের পথে বাধা দেওয়া মারমেইড রিসোর্টের কর্মী রেব হেম জানান, বিশেষ অনুমতি ছাড়া এই সেতুতে প্রবেশ নিষেধ। কর্তৃপক্ষের বিশেষ টোকেন ছাড়া এখানে কাউকে ঢুকতে দিতে নিষেধ করা হয়েছে। পরে রেস্টুরেন্টের কর্মী সালাম এসে দাবি করেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় রাতে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। পরে তাকে ম্যানেজ করে সেখানে প্রবেশের অনুমতি মেলে প্রতিবেদকের। ভেতরে প্রবেশের পর দেখা মেলে আরেক কর্মী ওসমান গণির।
প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণ জানতে চাইলে ওসমান বলেন, এখানে শুধু রুমে যারা আছেন, তারা আসতে পারবেন। আর প্রতি মাসে একটি বিশেষ ‘ডিজে পার্টি’ হয়। জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা ফি নেওয়া হয়। শুধু তারাই এখানে আসার অনুমতি পান।
বিশেষ ডিজে পার্টিতে কী কী থাকে বা কী খাবার থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেমন কিছু না, শুধু বিদেশি বিয়ার বা মদ, আর নাচ-গান থাকে।তবে ঝাউবীথি কেটে কেনো এমন স্থাপনা তৈরি করার বিষয়ে কেউ কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
জানা যায়, মারমেইডের মালিক সোহাগ স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে হুমকিধমকি দিয়ে কিছু কাগজি জমি ক্রয় করেন। তারপর থেকে সেই জমির পাশের সমুদ্র সৈকতের বিশাল বালিয়াড়ি এলাকা অবৈধভাবে দখলে নেন। মারমেইডের বিশাল এলাকার অধিকাংশই খাসজমি ও সৈকতের বেলাভূমি। অল্পসংখ্যক জমি কিনে পাশের খাসজমি ও সৈকতের বালিয়াড়ির মধ্যেই গড়ে উঠেছে রিসোর্টটি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বালিয়াড়ি, পাথরময় জোয়ার-ভাটা অঞ্চল, উপকূলীয় জলাভূমি ও কোরালসহ সামুদ্রিক দ্বীপ রক্ষায় কক্সবাজারের সৈকত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে সরকার।
এ নির্দেশনামতে, ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটারে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন নিষিদ্ধ এবং ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি মারমেইড সেই আদেশ অমান্য করে সবকিছুই তৈরি করেছে।
এছাড়া ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ারভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) মাস্টারপ্ল্যান। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমুদ্র সৈকতের ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচার চালানো হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি এইচ এম এরশাদ বলেন, রহস্যজনক কারণে উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে ইসিএ এলাকায় সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করা না হয়, তাহলে পরিবেশগত বড় হুমকিতে পড়বে পর্যটননগরী কক্সবাজার। তাই দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন হিমছড়ি টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, রাতের আঁধারে ঝাউবীথি কেটেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু গভীর রাতে কাটায় আমরা তাদের ধরতে পারছি না। ম্প্রতি একটি মামলাও করা হয়েছে তাদের বিরোদ্ধে।
এ বিষয়ে মন্তব্য নিতে মারমেইড বিচ রিসোর্টের মালিক আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, সরকারি জমি হোক আর ব্যক্তিগত জমি হোক, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ নেই। খাস বা সৈকতের বালিয়াড়ির জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।
কেকে/এএম