জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের ওপর জোর দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান ভলকার তুর্ক।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ড যে-ই ঘটাক না কেন, তার তদন্ত হতে হবে। কোনো ধরনের ‘মব জাস্টিস’ গ্রহণযোগ্য নয়। দুই দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ দিন ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান। এ সময় ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক লিউইস গুইনও উপস্থিত ছিলেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্তে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশন গত ৫ থেকে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগও তদন্ত করছে।
হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বাংলাদেশে অবহেলিত, প্রান্তিক তরুণ জনগোষ্ঠীর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নজিরবিহীনভাবে রাস্তায় নেমে আসার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ভিন্নমতকে স্তব্ধ করে দিতে এখানে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ দেশে তীব্র বৈষম্য, অসাম্য, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। এসবের বিপরীতে আন্দোলনকারীদের দাবির কেন্দ্রে ছিল মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার।
তুর্ক বলেন, গত দুই দিনে সরকার, নাগরিক সমাজ, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা থেকে তাঁর মনে হয়েছে যে এ দেশের মানুষ পরিস্থিতি উত্তরণে আশাবাদী। উত্তরণের পর বাংলাদেশ অন্য এক বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে, ‘এবার অবশ্যই ন্যায়বিচার হতে হবে। গত কয়েক দশকের অপমানজনক চর্চার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে এবার সংস্কার অবশ্যই টেকসই ও স্থিতিশীল হতে হবে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার অতীতের বিভাজন, বৈষম্য ও দায়মুক্তি এড়িয়ে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে সুশাসন, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানান। তিনি নিবর্তনমূলক আইন সংস্কার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনেও গুরুত্বারোপ করেন।
হাইকমিশনার তুর্ক রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ আরো দৃশ্যমান হওয়ার ওপর জোর দেন। তিনি আশা করেন, চলমান সংসারপ্রক্রিয়া গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক বিভাজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গত জুলাই ও আগস্টে বর্বর সহিংসতায় শহীদসহ আহতের কথা স্মরণ করে তুর্ক বলেন, তাদের ন্যায়বিচার পাওয়া একটি অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, ‘যে কোনো দমন-পীড়ন, অভ্যুত্থান ও সহিংসতার পর এগিয়ে যাওয়ার জন্য সত্য অনুসন্ধান ও নিরাময়ের জাতীয় প্রক্রিয়া থাকা দরকার।’
ভলকার তুর্ক একটি জাতীয় সংলাপ প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ফৌজদারি অপরাধের বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাড়াহুড়া করে যেন অভিযোগ আনা না হয়, তা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ সর্বত্র যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচারের মান বজায় রাখার ওপর জোর দেন। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড ব্যবস্থা বিলোপ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনার আহ্বান জানান।
তুর্ক বলেন, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক হওয়া বা সম্পৃক্ততার কারণেই কারো বিরূদ্ধে ফৌজদারি মামলা যেন করা না হয়, তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যথাযথ তদন্ত ছাড়াই বেশ কয়েকজন সাংবাদিকসহ অনেকের নামে অভিযোগ দায়ের হওয়া উদ্বেগের।অতীতের এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের প্রতি মানবিক ও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার আহ্বান জানান।
আন্দোলনের সময় পুলিশ হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য নিহতের ঘটনায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা না নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত বা কার্যত দায়মুক্তি প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে সংবাদ সম্মেলনে।জবাবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রধান বলেন, ‘যেকোনো হত্যার ক্ষেত্রে, হত্যা যে-ই করুক না কেন, তদন্ত হতে হবে।এটি খুবই স্পষ্ট।গত আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব জাস্টিস’ প্রসঙ্গে ভলকার তুর্ক বলেন,‘আরেকজন মানুষকে আঘাত—সহিংসতা যে-ই করুক না কেন, অবশ্যই তদন্ত হতে হবে। কোনো ধরনের মব জাস্টিস গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রসঙ্গে ভলকার তুর্ক বলেন, "আইন ও আদালত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় এখানে ঘাটতি আছে।মানবাধিকার আইন বিবেচনায় এটি স্পষ্ট।এগুলো সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। ন্যায়বিচার ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য এটি সংস্কার হওয়া দরকার। আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।"
সংবাদ সম্মেলনে গায়েবি ও হয়রানিমূলক মামলা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ভলকার তুর্ক বলেন, ‘এটিকে ইস্যু হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে।আমি একে স্বাগত জানাই।তুর্ক বলেন, ‘আমরা অতীতের পুনরাবৃত্তি হতে দিতে পারি না। অভিযোগ ও মামলা যথার্থ হওয়া উচিত। তাঁরাও ন্যায়বিচার ও যথার্থ প্রক্রিয়া পাওয়ার অধিকার রাখেন।’
নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি প্রসঙ্গে হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, ‘ন্যাশনাল হিলিং প্রসেস’ (জাতীয় নিরাময় প্রক্রিয়া)-এর উদ্ভব সব সময় ওই দেশ থেকেই হতে হয়। এই নিরাময়ের জন্য জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ও ভালো উপলব্ধি প্রয়োজন। এ জন্য অতীতের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি না হওয়াটা জরুরি।
ভলকার তুর্ক বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে এর অর্থ হলো, তারা মানবাধিকার আইনের ধারা দ্বারা স্পষ্টতই পরিচালিত হবে।মানবাধিকার মানুষের সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা উৎসাহিত করে। অবশ্য মানবাধিকার আইনে কিছু বিধি-নিষেধ আছে। কিন্তু থ্রেশহোল্ড অনেক বেশি।তুর্ক বলেন, ‘আমি আশা করি, আপনারা যখন এই প্রক্রিয়ায় যাবেন, মানবাধিকার আপনার দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। এটি আপনাদের অত্যন্ত জটিল নিরাময় প্রক্রিয়ায় পথ দেখাবে।’
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দল বা সংগঠন নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে ভলকার তুর্ক বলেন, “আমরা সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ নিয়ে খুব কথা বলি না।আমরা এর প্রভাব দেখেছি।দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘সন্ত্রাসী’ ট্যাগ দেওয়া হয়।”
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান বলেন, ‘আমাদের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।তিনি পুরো দেশকে প্রশমিত করেছিলেন।তাঁকেও দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অতীতে এখানেও ভিন্নমত এবং সমালোচনা দমনে এভাবে সন্ত্রাসী তকমা দিতে দেখেছি। এখান থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে কিভাবে ভিন্নমত দমনে সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া হয়।’
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগের তদন্ত দাবি প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বলেন, ‘এটি আমাদের সত্যানুসন্ধান মিশনের কাজের অংশ।সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা মানবাধিকার কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগগুলোর যথাযথ তদন্ত হওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিস্থিতি খুব বিশৃঙ্খল।প্রচুর অপতথ্য, অপপ্রচার আছে। প্রকৃত হামলার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ।’
বাংলাদেশের মতো দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর কেন কার্যালয় খুলতে চায়—এ প্রশ্নও উঠেছিল ব্রিফিংয়ে। জবাবে হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, যখন একটি দেশ রূপান্তরের পথে থাকে তখন অনেক অভিজ্ঞতা, পরামর্শ প্রয়োজন হয়।দেশগুলোর প্রয়োজন নিয়ে সহযোগিতা করাই মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের কাজ।
তুর্ক বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানবাধিকার নিয়ে অনেক অপতথ্য আছে।অনেকে একে পশ্চিমা মতবাদ হিসেবে দেখে। অনেকের চোখে মানবাধিকার একটি নাগরিক ও রাজনৈতিক বিষয়।আবার অনেকে একে চাপিয়ে দেওয়া বিষয় হিসেবে দেখে।তুর্ক আরো বলেন, শতাধিক দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয়ের উপস্থিতি আছে।পশ্চিমা দেশেও আছে।যেকোনো দেশে সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অনেক সময় কঠিন বিষয়। এ জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।ঢাকা সফরকালে তাঁর মনে হয়েছে, সবাই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সহযোগিতা চায়।
সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যের সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, সমস্যা হলো অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স এখনো তিন মাস হয়নি। তাদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। আবার পরিবর্তনের দাবিও অনেক। তাদের সহযোগিতা দিতে হবে। ধৈর্য ধরা, সংস্কার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কারে মানবাধিকার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে হবে।
কেকে/এমআই