জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করেছে। গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমান দেন কমিশন প্রধানরা। দুই কমিশনই রাষ্ট্র সংস্কারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেশ করে। এর মধ্যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের লক্ষ্যে দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ, সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণবিধি প্রণয়ন, ভারতের নয়াদিল্লির আদলে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্মেন্ট’ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন দণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা মওকুফে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে।
এ ছাড়া স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন ও মোবাইল কোর্ট বিচার বিভাগের অধীনে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশকে চার প্রদেশে ভাগের সুপারিশদেশকে চার প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। পাশাপাশি নতুন করে আরো দুটি বিভাগ করার প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণে সুবিধা হবে, এ জন্য দেশকে চার প্রদেশে ভাগ করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। পাশাপাশি কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইমিগ্রেশনের জন্য আলাদা পুলিশ ইউনিট গঠনের সুপারিশ।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সংখ্যা কমানোর প্রস্তাবও করেছে বলে জানান আজাদ মজুমদার। তিনি বলেন, কমিশন ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪৪টি অধিদফতর করার পরামর্শ দিয়েছে।
নয়াদিল্লির আদলে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ গঠনের সুপারিশজনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে ভারতের নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট বা রাজধানী মহানগর সরকার গঠনের সুপারিশ করা হলো। অন্যান্য প্রদেশের মতোই এখানেও নির্বাচিত আইন সভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’-এর আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।
জেলা প্রশাসকের পদবি পরিবর্তনকমিশন জেলা প্রশাসক পদের নাম নিয়ে সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে, সরকারি চাকরি করেন, অনেকেই তাদের প্রশাসক হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন না। সেক্ষেত্রে এ পদের নাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা কমিশনার করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর মামলা (নালিশি মামলা) প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হলো। তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরবর্তীতে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকরা সহজে মামলা করার সুযোগ পাবেন।
সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুবিধা বাতিল কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্য ও সরকারের খরচ কমাতে উপসচিব থেকে ওপরের স্তরের কর্মকর্তাদের জন্য সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সচিবালয়ের উপসচিবদের গাড়ি ক্রয়ের ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সুযোগ সচিবালয়ের বাইরে অন্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য নেই। এ ব্যবস্থা বাতিলের জন্য সুপারিশ করা হলো। ব্যবস্থাটি বাতিল করলে কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্য দূর হবে এবং সরকারের খরচও কমবে বলে মত দিয়েছে কমিশন।
বিসিএস পরীক্ষা এক বছরে শেষ করতে সময়সীমা নির্ধারণকমিশন মনে করছে, বিসিএস পরীক্ষার দীর্ঘ প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সরকারি পরীক্ষায় নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আরো দ্রুত এবং কার্যকর হবে। প্রস্তাবিত নতুন সময়সীমা অনুযায়ী, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষার বার্ষিক ক্যালেন্ডার নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
এতে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এপ্রিল মাসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, জুনে মূল লিখিত পরীক্ষা, ডিসেম্বরে ফল প্রকাশ এবং জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিবিএসের সব ক্যাডারকে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের সুপারিশলিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন না করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একইসঙ্গে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা কোনো গোয়েন্দা বিভাগের কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথাও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পূর্বে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা যাবে না।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ কোনো দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শনে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের যে এখতিয়ার রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। ২৮ দফা প্রস্তাবের ছয় নম্বরে রয়েছে ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন’ সংক্রান্ত অংশটি। এতে বলা হয়েছে, আদালত কর্তৃক চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বোর্ড প্রতিষ্ঠা, যার সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস, বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চের সুপারিশবিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস, স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা, বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট ডিভিশনের স্থায়ী বেঞ্চ, জেলা আদালতকে সম্প্রসারিত করে উপজেলা পর্যায়ে এবং আদালত অঙ্গন দলীয়করণ মুক্ত রাখতে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও কার্যকর করার সুপারিশবিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট সংবিধান-সংশোধনী বিষয়ে প্রতিবেদনের ৬ নম্বর পৃষ্ঠা ৮ পয়েন্টে বলা হয়।
১. প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংবিধানের বিধানগুলো সংশোধন, যার মধ্যে রয়েছে, অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) (রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সীমিত করে নিয়োগ কমিশনকে ক্ষমতায়িত করা), ৫৫(২) (প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা থেকে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগের বিষয়কে পৃথক করা), ৯৪ (বিচারকদের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির মতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা ৭ জন করা), ৯৫ (রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকবে না বা নির্বাহী বিভাগের কোনো প্রভাব থাকবে না।
২. বিচারক হিসাবে নিয়োগের যোগ্যতা পরিবর্তন, যথা প্রার্থীকে কেবল বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স অন্যূন ৪৮ বছর হতে হবে। বিচারকদের অবসরের বয়স বিদ্যমান ৬৭ বছরের পরিবর্তে ৭০ করা যা ভবিষ্যতে নিযুক্ত বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য হবে। বিদ্যমান ১০ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার পরিবর্তে ১৫ বছরের পেশাগত বাস্তব অভিজ্ঞতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা)। সংবিধানে নতুন বিধান ৯৫ক অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ কমিশন এর বিধান করা।
৩. সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার জন্য ৬৪ক অনুচ্ছেদ সংযোজনসহ বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিধানাবলি সংশোধন।
এদিকে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমাতে প্রতিবেদনের ৮ পৃষ্ঠার ১৪ পয়েন্টে সুপারিশ করা হয়েছে, বিচারকদের ছুটি, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, আদালতে প্রকাশ্যে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা না করা, আইনজীবীর মৃত্যুতে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বিচারপ্রার্থীগণ যে হয়রানির শিকার হন, তার প্রতিকার বিধান।
এ ছাড়া বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিবেদনের ৮ পৃষ্ঠার ১৫ পয়েন্টে বলা হয়েছে।
১. সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন সব পর্যায়ের বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দুর্নীতিবিরোধী সুস্পষ্ট বিধানসংবলিত আচরণবিধিমালা প্রণয়ন। প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ এবং তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা।
২. প্রতি তিন বছর পর পর সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে এবং অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রে জেলা আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা।
৩. সুপ্রিম কোর্ট-এর বিচারকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লিখিতভাবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে পৌঁছানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ বাক্স স্থাপন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিলের জন্য ডেডিকেটেড ই-মেইল অ্যাড্রেস জনসাধারণকে প্রদান করা।
কেকে/এআর