জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে দমন-পীড়ন চালায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। এতে শত শত মানুষ প্রাণ হারান। আহত হয়েছেন অনেকে। পরে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
একই সঙ্গে বিএনপিসহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে জোরালো দাবিও জানিয়েছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নামে ও মতাদর্শে কোনো রাজনীতি করার তাদের সুযোগ নেই।
যেভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে আ.লীগ
গত ১৯ আগস্ট আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে একটি রিট করেছিলেন ‘সারডা সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষে এর নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া। কিন্তু গত ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রিট খারিজ করে দেন। এদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন নিয়ে এক মতবিনিময় সভা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সভায় গণহত্যায় কোনো বাহিনী বা দলের সম্পৃক্ততায় গুম, খুন যৌন নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ও জড়িত রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর নিষিদ্ধ করাসহ ৮টি সংশোধনীর প্রস্তাব করে আইন মন্ত্রণালয়।
‘স্বৈরাচারের বিচার করতে হবে’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কিছু কিছু মানুষ সংস্কার সংস্কার বলে নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করছে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে সংস্কারের মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না। আমাদের দ্রুত জনগণের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের শাসন নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। বুধবার বিকালে সোনাগাজী ছাবের পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে উপজেলা বিএনপির সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি আরো বলেন, স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও যাওয়ার আগে হাজার হাজার মানুষকে যারা হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, তাদের বিচার করতে হবে। যারা এ আন্দোলনে নিহত হয়েছে তাদের পরিবার যেন সঠিক বিচার পায়। দল-মত নির্বিশেষে স্বৈরাচারকে হঠাতে নিজের জীবন বাজি রেখে জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নিহত ও আহতদের ত্যাগের মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশকে গঠন করতে হবে।
‘ ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে রাজনীতির সুযোগ নেই’
আওয়ামী লীগ নামে, আওয়ামী লীগ মতাদর্শে কোনো রাজনীতি করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। এর কারণ হিসেবে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘তাদের মতাদর্শটা ফ্যাসিবাদী, যার ভিত্তিতে গত ১৫ বছরের রাজনীতি চলেছে, গণহত্যা হয়েছে। যারা ভুল বুঝতে পারবেন, তাদের সেই আদর্শটাকে ত্যাগ করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারের তো কোনো সমস্যা নেই। অন্য দলে যোগ দিতে পারেন, নতুন দল গঠন করতে পারেন।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না-এ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না বা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, এ বিষয়ে আমাদের একটা জাতীয় ঐকমত্যে আসতে হবে। আদালত, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য জায়গা থেকে এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা আসে সেটা সামনে বোঝা যাবে। তবে আমরা যারা অভ্যুত্থান করেছি, তারা মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই।’
আওয়ামী লীগের রিকন্সিলিয়েশন প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘সেটা বলেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যানারে, শেখ পরিবার বা চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও গণহত্যাকারীদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’
‘আ.লীগ নামে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আওয়ামী লীগ নামে বাংলাদেশে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না। সে আওয়াজ আমরা উঠাচ্ছি। আমরা তাদের এ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিচার দাবি করছি। বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আঞ্চলিক সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘জাতীয় ঐক্য ও বর্তমান বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগকে একদিকে চাইবেন তারা রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হোক, আবার আপনারা তাদের বিচার করবেন না, পুলিশ দিয়ে তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেবেন, এত স্ববিরোধিতা ঠিক নয়। আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বলেছিলাম, সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করা হোক।
‘আ.লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন বলেছেন, ‘গণঅধিকার পরিষদ শুরু থেকেই গণহত্যার বিচারে সোচ্চার। কিন্তু সরকারের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গণহত্যার বিচার ও আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না করলে যমুনা ঘেরাও করা হবে।’ বুধবার দুপুরে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় আলরাজি কমপ্লেক্সের সামনে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। রাশেদ খাঁন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে পাপ করেছে, ওরা কোনো ক্ষমা পেতে পারে না। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে ফাঁসিতে ঝুলাতে হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহানুভূতি দেখানো মানে শহিদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা। এ বেইমানি যারা করবে, তাদের অবস্থাও আওয়ামী লীগের মতো হবে।’
কেকে/এআর