রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় গত মঙ্গলবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় তিন সমন্বয়ককে আটকের ঘটনায় সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, উত্তরার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের একটি গ্রুপ থানায় এ হামলা চালিয়েছে। তথ্য বলছে, এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজির ভাগ-বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত বিরোধ। এক পক্ষের দাবি, ‘গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আয়োজনের নামে সমন্বয়ক পরিচয়ে আসাদুর রহমান আকাশ, ইয়ামিন রহমান, বাপ্পি খান, নাফিস আহাম্মেদ রাহাত, রওনক জাহান সিঁথি, সোয়াদ মাহমুদ শাইখ, লাবিব মোহান্নাত, নাবিল, রাজু ও সাকিবসহ একটি চক্র উত্তরার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক নেতাদের ব্ল্যাকমেইল করে অন্তত ১৮ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন।
কিন্তু প্রোগ্রামে খরচ হয়েছে মাত্র ৬-৭ লাখ টাকা। বাকি টাকা আকাশ, রবিন, বাপ্পি, রাজু ও সাকিব চক্রটি আত্মসাৎ করে ফেলেন। পরবর্তীকালে এসব বিষয়ে তাদের কাছে এ টাকার হিসাব চাইতে গেলে সৈয়দ সামিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীর ওপর চক্রটি হামলা করে। এরপর হামলার ঘটনায় উত্তরা পূর্ব থানায় ভুক্তভোগী সামিউল একটি লিখিত অভিযোগ করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার সমন্বয়ক পরিচয়ধারী ৩ শিক্ষার্থীকে পুলিশ আটক করেছিল। আর এতেই বাধে যত বিপত্তি।’
এদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল উত্তরায় মুগ্ধমঞ্চে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বৈষম্যবিরোধী একাংশের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে সোয়াদ মাহমুদ শাইখ বলেন, ‘গত ১৬ ডিসেম্বর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে আয়োজিত প্রোগ্রাম থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে ৮ লাখের কিছু বেশি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেখানে ব্যয় হয়েছে ৯ লাখেরও বেশি।’ আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকার লেনদেন একটি লিমিটেড কোম্পানির মাধ্যমে হয়েছে, যার অডিট রিপোর্ট আমাদের কাছে রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা শিগগিরই গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানাব।’
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র সংগঠনটির নেতারা জানান, সোমবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানার চেকারস রেস্টুরেন্টে সংগঠনের একটি মিটিং চলছিল। মিটিং শেষ হওয়ার আগেই জুবায়ের নামে এক ব্যক্তি তার সহযোগীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। কিছুক্ষণ পর এসআই সাঈদের নেতৃত্বে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে বৈঠকে থাকা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং তিনজন পুরুষ ও একজন নারী শিক্ষার্থীকে থানায় নিয়ে যায়। সংগঠনটির দাবি, ওই নারী শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ কটূক্তি করে এবং থানায় নিয়ে গিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করে। এ ঘটনার খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা থানার সামনে জড়ো হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
সংগঠনের নেতারা বলেন, ‘আমরা বারবার পুলিশের কাছে আটক শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কপি চেয়েছি, কিন্তু সন্ধ্যার পর আমাদের তা দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নেতাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে উত্তরা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অপরপক্ষ। এতে অভিযোগকারী কাজী জুবায়েরসহ শতাধিক শিক্ষার্থী এ সম্মেলনে অংশ নেন। জুবায়ের জানান, থানায় অভিযোগ করার পর থেকে তারা বাড়িছাড়া। থানায় হামলার ঘটনার পর এখনো পর্যন্ত তারা বাড়ি ফিরতে পারেননি। তাদের ফোন ও ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে বলা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতেও ভয় পাচ্ছেন। জুবায়ের আরো বলেন, থানায় হামলার ঘটনার পর সেখানে যেতেও তারা দ্বিধাবোধ করছেন। তাদের বক্তব্য, যেখানে পুলিশ নিজেদেরই সুরক্ষিত রাখতে পারছে না, সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তো আরো অসহায়। তাই তারা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে জুবায়ের বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে কিছু শিক্ষার্থী একটি কনসার্টের আয়োজন করে। এরপর বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং কোম্পানি থেকে স্পন্সরের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য তারা উত্তরা পূর্ব থানায় একটি অভিযোগ করেন। পুলিশ তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়। এরপর অভিযুক্তরা বিষয়টি জানতে পেরে জুবায়েরসহ কয়েকজনকে থানার পাশের গলিতে ডেকে নিয়ে আলোচনার নামে আকাশের নেতৃত্বে অন্তত ৫০ জন তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। জুবায়ের আরো বলেন, ‘অভিযুক্তরা জুলাই অভ্যুত্থানে আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু আজ তারা বিপথে পা বাড়িয়েছেন। এটি শহিদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানির শামিল।’ এসময় তিনি এই ঘটনায় প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার তিন ছাত্র সমন্বয়ককে গ্রেফতার করে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ, মামলাটি পূর্ব থানার হওয়ায় সেই থানাকে আসামি বুঝিয়ে দেন থানা থেকে। সমন্বয়কদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির করেন আরো বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক। তাতে কাজ না হওয়ায় দলবেঁধে প্রথমে উত্তরা পূর্ব থানায় হামলা চালায়, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ উত্তরা পশ্চিম থানায় এসে আবারো হামলা চালায় ছাত্র সমন্বয় পরিচয়ে কিছু শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় পরিস্থিতি বেসামাল হলে থানা থেকে সেই তিন সমন্বয়কে ছেড়ে দেন পুলিশ। এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয়ে বেশ কিছু মানুষজন থানায় হামলা চালায়, পরে খবর পেয়ে এলাকাবাসী ছুটে আসেন।
কেকে/এআর