আমি তখন মার্কেটিংয়ে চাকরি করি। এমন মার্কেটিং চাকরি টার্গেট পুরন না হলে সে মাসের বেতন হতনা। বেতনও এমন ছিল একমাসের বেতন দিয়ে কোনভাবে একমাসই চলা যেত।
এমন অবস্থায় মাঝে মাঝে বাকী খাওয়া প্রয়োজন হত। না খেয়ে থাকতে ভালো লাগে। কারো কাছে বাকি চাওয়া বা ধার চাওয়া খুব কষ্টের কাজ। তবু সব দিন না খেয়ে থাকা যায়না।
অফিসের সামনেই চায়ের দোকানে বাকি খেতাম। দোকানদার একজন বয়স্ক লোক, দেখতে সুন্দর। চাপদাড়ি কিন্তু রাখেনা, চশমা পড়ে। ছোট ছেলে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়াশোনা করে। নিরেট একজন সাবলীল ভদ্রলোক। একদিন আমার বাকির হিসেব করছে। বাকি খাওয়াই কঠিন, তারপর আবার বাকির হিসাব দেওয়া বিব্রতকর।
তাকে বললাম কাকা, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা শুনেন, আমি যদি জানা সত্বে আপনাকে না বলে একশো টাকায় এক টাকাও কম দেই তাহলে আমার একশো টাকাই হারাম হয়ে যাবে। এ কথার পর আর কোনদিন সে আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। এরপর একদিন মনে হলো, না সে একটু জিজ্ঞেস করলেও ভালোই ছিলো। কারন ভুলে যাওয়ার কোন কারণ হতে পারে। যাই হোক এরপর মনে মনে ভাবতে থাকি, আল্লাহ আমি যেন ভুলে না যাই, প্রয়োজনে বেশি হোক কিন্তু কম যেন না হয়।
একদিন দুপুর বেলা রুটি কলা খাচ্ছি। আমার বেঞ্চে আরো কলিগ বসা। আশে পাশে আরো লোক দাঁড়িয়ে। একজন মুরুব্বি লোক আসলেন। হ্যাংলা পাতলা মিডিয়াম লম্বা, দাড়ি আছে। যেমন সাদা পাঞ্জাবি তারচেয়ে বেশি সাদা তার মুখ মন্ডল। যেন কোন স্কুলের অবসর প্রাপ্ত হেডমাস্টার।
তাকে আর কোনদিন দেখি নাই। শিশুর মত সুন্দর মুরুব্বি তিন চারজন লোকের কাছে সাহায্য চাইলেন। একদম মুখের কাছে হাত বাড়িয়ে অল্প শব্দে দুই টাকা সাহায্য চাইলেন। একজন লোকও একটা টাকা দিলোনা। অথচ তাঁরা দোকানের পাশে দাড়ানো কিছু খরচ করতে। আমি কথা বলছি, খাচ্ছি আর আড়ালে দেখছি। শেষে আমার কাছে আসলো। আমি পকেটে হাত দিতে বললো, একটা রুটি খাবো। দোকানে বললাম ওনাকে একটা রুটি দেন। রুটি দিতে চাইলে মুরুব্বি বললেন, না কেক খাবো। দোকানদার কাকা একটু রেগে গেলেন। বললো চাইলেন রুটি এখন আবার কেক চাচ্ছেন।
আমি তাকে নিবৃত করলাম, বললাম থাক কেকই দেন। মনে মনে ভাবলাম দোকানদার হয়তো তাকে কাঁচা পানি দিতে পারে। তাই তাকে বললাম গ্লাস ধুয়ে মুরুব্বিকে এক গ্লাস ফিল্টার পানি দেন। দোকানদার কাকাও গ্লাসটা সুন্দর করে ধুয়ে এক গ্লাস পানি দিলেন। আমি গ্লাসটা হাতে নিয়ে মুরুব্বির হাতে দিলাম। তিনি সম্ভবত ক্ষুদার্ত ছিলেন, দ্রুত কেক খাওয়া শেষ করলেন। আমার হাত থেকে গ্লাস নিতে একটু হাত কাপছিলো। পানি পান করে মুরুব্বি উঠে দাঁড়ালেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কাকা চা খাবেন।
তিনি উত্তর দিলেন, না। আমি আবার বললাম, আপনি মুরুব্বি মানুষ পান খাওয়ার কথা। পান খান, সে উত্তর দিলো, না পান খাইনা।
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই তিনি পান খান না। আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার খাওয়া শেষে সে বসা অবস্হাতেই আমার মাথা থেকে বুক পর্যন্ত দুই হাত দিয়ে দোয়া দিতে লাগলেন। আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যাই। আমার সাদা ফকফকে আয়রন করা পোশাক, কিছু সে মানলোনা। আমিও অবোধ বালকের মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি যেন সুযোগ পেয়ে, মাথা থেকে বুক পর্যন্ত বারবার। শক্ত করে চাপ রেখে হাত বুলাতে লাগলেন। আমার বুকে হাত বুলানো একটু কঠিন। কারন একসময়ে একশোর বেশি বুক ডাউন একসাথে দেওয়া আছে আর বুক যেন পাষানের মত শক্ত।
এতটা হাত বুলালেন যেন তিনি দূর্বল হলেন, তারপর থামলেন। আমার মনে হলো এক পিস কেকের চেয়ে বেশি কষ্ট করে ফেলেছেন। শক্ত বাধন খুলে দিলে যেমন শরীর হালকা হয়। গলায় আটকে যাওয়া খাবার বা পানি নেমে গেলে যেমন হালকা লাগে। তেমন শরীর একদম হালকা হয়ে গেলো।
ইচ্ছে করছিলো বলতে কাকা আরেক পিস কেক বা অন্য কিছু খান। কিন্তু তিনি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সরে পড়লেন। এবং অবাক করা বিষয় হলো ধারে কাছেও না, আড়লে। আত্মতৃপ্তিতে মন ভরে উঠলো। মনে হলো কি খাওয়ালাম আর কি খেলাম। এমন আত্নতৃপ্তিতে মন ভরে উঠলো, এ যেন এক বিশাল পাওয়া।
তিনি সরে যাওয়ার পর আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম মাটি তুমি আজ দিনের স্বাক্ষী। তুমি জানো আজ দিন আমার উপর কি হয়ে গেছে। মাটি তুমিও কিছু দোয়া করে দেও। মুরুব্বি এতটা দিতে পারলে তুমি কিছু পারবে না কেন।
আত্মতৃপ্তির রসদে কষ্টকে করি বারণ
মনে মনে করি বিশ্বাস অবশ্যই মহান
একদিন দিবেন ঠাই কৃপা চরণ।