ফেনীর পরশুরামে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে নির্মিত আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের আলিশান বাড়িটি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা নামলে পরশুরাম পৌরসভার গুথুমা গ্রামে অবস্থিত এই বাড়ির সামনে ছাত্র-জনতাসহ সাধারণ মানুষ জড়ো হতে শুরু করে। রাতের সাথে সাথে বিক্ষোভের গতি আরো বাড়ে এবং একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধরা বাড়ির গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির জানালা ও দরজা খুলে নেওয়া হয়, জানালার কাচ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ভবনের ইট খুলে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। পরে ছাত্র-জনতা বাড়িটির ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ফেনী-১ আসনের সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের এই বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, কালোবাজারি, অবৈধ কর্মকাণ্ড এবং পাপাচারের আড্ডা হিসেবে পরিচিত ছিল। সুন্দরী নারীদের আনাগোনা, মদের আসর, নাচ-গান — সবই চলত প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। স্থানীয়রা বাড়িটিকে ‘পাপের বাড়ি’ নামে আখ্যায়িত করেছিল।
এই বাড়িটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অবসরস্থল ছিল না, বরং এটি ছিল একটি অপরাধের কেন্দ্র, যেখানে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড চলত। এখানেই নানা কালোবাজারি, মাদক চোরাকারবারি এবং নৃত্যশিল্পীদের মাধ্যমে কুৎসিত অনুষ্ঠান আয়োজিত হতো। একাধিক সূত্র দাবি করে যে, এই বাড়ি থেকে মাদক, ফেন্সিডিল, এবং অন্যান্য অবৈধ সামগ্রী ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হতো।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার পদে আসার পর নাসিম প্রশাসন, ব্যবসা এবং সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মে হাতছাড়া করতে থাকেন। অভিযোগ আছে, সে সময় নাসিম বিনা টেন্ডারে সরকারি কাজ পাইয়ে দিতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন টেন্ডার ও প্রকল্পের জন্য কমিশন নিতেন। ‘মিস্টার টোয়েন্টি পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি, যার অর্থ হলো কোনো টেন্ডার বা কাজ পাবার জন্য তাকে ২০% কমিশন দিতে হতো।
তার নির্দেশে বালুমহাল, টেন্ডার বাণিজ্য, সালিশ বাণিজ্য, এবং নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ লেনদেন চলত। বাংলাদেশ থেকে পাচার হতো স্বর্ণ, মাদক এবং বিভিন্ন পণ্য। তার অপরাধ সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তিনি দেশব্যাপী অপরাধী মহলের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
নাসিমের বিরুদ্ধে নানা নারীকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ রয়েছে। একাধিক নারীকে তার লালসার শিকার হওয়ার পর সামাজিক মর্যাদার কারণে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানানো সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক নারী জিনাত রিজওয়ানা নাসিমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন, যেখানে তার নিপীড়ন ও প্রতারণার বর্ণনা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতেও তার ব্যাপক প্রভাব ছিল। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট করেছেন। তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচার করার কাজ তিনি করেছিলেন। কয়েকটি বিদ্যুৎ কোম্পানির ৩০% শেয়ারও তার মালিকানায় ছিল। এসব কোম্পানির মাধ্যমে তিনি মাফিয়া সিন্ডিকেটের মতো অর্থ লুটে বিদেশে পাচার করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলাউদ্দিন নাসিম ভারতে আত্মগোপন করেছেন। তবে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্ত চলছে। তার বিপুল অংকের দুর্নীতির টাকা, অবৈধ সম্পদ এবং পাচারের ব্যাপারে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে দুদক চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
২০১৭ সালে পরশুরামে নাসিমের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ’ এর জন্য কৃষিজমি জবরদখল করা হয়। এক্সকেভেটর দিয়ে জমি কাটার পর সেখানে লাল পতাকা টাঙানো হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সেখানে জমি অধিগ্রহণ নয়, বরং জবরদখল করা হয়েছে।
কেকে/এএম