চায়ের রাজ্যখ্যাত পর্যটন নগরী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে রয়েছে 'টি মিউজিয়াম। যা বাংলাদেশের প্রথম চা জাদুঘর হিসেবে পরিচিত। শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশ চা-বোর্ডের ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়াম’টি মূলত এটি অবকাশ যাপনের রিসোর্ট হলেও সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম‘চা জাদুঘর’।
এই চা জাদুঘরটি একদিকে চা শিল্পের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ করছে, অন্যদিকে চা ব্যবসায়ী এবং পর্যটকদের কাছে শ্রীমঙ্গলের পরিচিতি আরো বাড়াচ্ছে। চারপাশে সবুজ চা-বাগানে ঘেরা এ জাদুঘওে বাংলাদেশের চা-শিল্পের প্রায় দেড়’শ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে নানা সংগ্রহে-স্মারকে।
সরেজমিনে ব্যতিক্রমী এই জাদুঘর ঘুরে দেখা যায় চার কক্ষ বিশিষ্ট এ জাদুঘরের প্রত্যেকটি কক্ষই আকর্ষণীয়। প্রতিটি কক্ষেই চা-গাছের গুড়ি ও কাচের ফ্রেম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট কয়েকটি টেবিল এবং কাচের ফ্রেম। এসব টেবিলের ওপরে এবং ফ্রেমের ভেতরে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের আসবাব সামগ্রি ও যন্ত্রপাতি।
প্রথম কক্ষের বড় একটি অংশজুড়ে রাখা হয়েছে একটি টেবিল ও চেয়ার। টেবিলের এক কোনায় ছোট তথ্যে জানানো হয়েছে ১৯৫৭-৫৮ সালে শেখ মুজিুর রহমান যখন পাকিস্তান চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন; তখন তিনি এই চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করেছিলেন।
দ্বিতীয় কক্ষে প্রবেশ করে দেখা যা, চা-গাছ ব্যবহার করেই আসবাব তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর ওপর প্রদর্শন করা হয়েছে এই কক্ষের সংগ্রহগুলো। চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল, রিং, কোদাল, তির-ধনুক, চা-গাছ ছাঁটাইকাজে ব্যবহৃত কলম দাসহ ব্রিটিশ আমলে শ্রমিকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন হাতিয়ার, আছে লোহার পাপোশ, চা-শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ রুপা ও তামার মুদ্রা, কাঠের ফসিল, ঘটি, টেবিল, ব্রিটিশ সাহেবদের গুনতির কাজে ব্যবহৃত হাড়ের ছড়ি, লাঠি; শ্রমিকদের পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত কষ্টিপাথরের প্লেট, ব্যবস্থাপক বাংলোয় ব্যবহৃত প্রাচীন বেতারযন্ত্র, দেয়ালঘড়ি, চা-বাগানে চারা লাগানোর কাজে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্র। চা শ্রমিক, কর্মচারী কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত সেসব অনুষঙ্গ দেখতে দেখতে মনটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
তৃতীয় কক্ষে রয়েছে চা শিল্পে ব্যবহৃত ব্রিটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, লিফট পাম্প, হস্তচালিত নলক‚প, বাগানের সীমানা ও জমি পরিমাপের জরিপ শিকল, সিরামিকের পানির ফিল্টার, সিরামিক জার, উনিশ শতকের প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, পুরোনো রেডিও টেলিফোন সেট, দা, টাইপ রাইটার, প্রাচীন পিএইচ মিটার ও চা প্রক্রিয়াকরণ সামগ্রি। করোসিনচালিত ফ্রিজ, গাড়ির চেসিস, চা-বাগানের ব্যবস্থাপক বাংলোর বাথটাব, ট্রাক্টরের লাঙলের অংশ, বাগান পাহারার কাজে নিরাপত্তারক্ষীদের ব্যবহৃত তীর-ধনুক, ব্রিটিশ ব্যবস্থাপকদের ব্যবহৃত খাট, দিক নির্ণয়যন্ত্র, চা-বোর্ডের হিসাবরক্ষকের ব্যবহৃত টাকা রাখার বাক্সসহ টেবিল। আছে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম কম্পিউটার ও টাইপ রাইটার, দেওয়ালঘড়িসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের অংশবিশেষও। রয়েছে নেপচুন চা-বাগান থেকে সংগৃহিত কেরোসিনের কুপি দিয়ে চালিত মাঝারি ফ্রিজ, মাথিউড়া চা-বাগান থেকে পাওয়া হাতে ঘোরানো টেলিফোন সেট। এছাড়া দীর্ঘদিন মাটির নিচে থেকে কাঠ-পাথরে রূপান্তরিত চার খ জীবাশ্ম ঠাঁই করে নিয়েছে কাচের ফ্রেমে।
চতুর্থ কক্ষে চা তৈরির যন্ত্রসহ এখানে রয়েছে কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত আসবাব, সাধারণ মানুষের কাছে চা জনপ্রিয় করতে প্রস্তুত প্রণালি এবং চা পানে স্বাস্থ্যগত কী কী উপকার হয় সেসব নিয়েই বিজ্ঞাপনী পোস্টার। এসব বিজ্ঞাপনী ভাষা পড়ে মনে হলো, সাধারণ মানুষের কাছে চা জনপ্রিয় করতে কী কাঠখড়টাই পোড়াতে হয়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।
চা বাগানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে এবং ব্রিটিশ আমলে চা-বাগানগুলোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রি সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মে সঙ্গে এ শিল্পের ঐতিহ্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য
বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চা জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা চা জাদুঘর দেখতে আসেন।
টি মিউজিয়ামের টিকিট কাউন্টারের সুত্রে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘরটি। জনপ্রতি প্রবেশ ফি ২০ টাকা দিয়ে যে কেউ প্রবেশ করতে পারেন এখানে। আরও জানা যায়, ছুটির দিনে এই জাদুঘরে প্রায় অর্ধশত পর্যটক আসেন। অন্যান্য দিনে দর্শনার্থী আসেন, তবে সংখ্যায় কিছুটা কম।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এ কে এম রফিকুল হক বলেন, তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে চা-বাগানের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো দেখেন। তাঁদের কাছে মনে হয়েছে পুরোনো জিনিস, একসময় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগামী প্রজন্ম এসব দেখতে পাবে না। এই বিষয়গুলো মাথায় নিয়েই তাঁরা এই চা জাদুঘরটি তৈরি করেন।
কেকে/ এমএস