চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত বুধবার প্রথমবারের মতো দেশের জনগণ ও নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। তার এ বক্তব্য দেওয়ার ঘোষণায় এদিন সকাল থেকেই জনমনে বাড়তে থাকে ক্ষোভ। প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার রাতে ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের বাড়িটিতে প্রথম হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। এসময় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ভবনটি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ভবনের বিভিন্ন অংশে। যা গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে শুধু ধানমন্ডি-৩২ নয়, ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরও। বিভিন্ন জেলায় দলটির কার্যালয় ও আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের বাড়িতে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। ভেঙে ফেলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও শেখ হাসিনার নামফলক।
বিশ্লেষকদের মতে, ‘শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল ভাষণের পর আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের ক্ষোভ আরো তীব্র হয়ে ওঠে। ফলে ধানমন্ডির-৩২ নম্বরের বাড়িটিসহ সারা দেশে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন।’
এদিকে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়ি, শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং মুজিব পরিবারের সদস্যদের নাম সংবলিত ফলক ভাঙচুরের ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এ ধরনের ঘটনা উসকে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছে প্রায় সব দল।
বিএনপি বলছে, ‘এত মানুষের মৃত্যু ও ১৫ বছরের নির্যাতনের ক্ষোভ মানুষের মধ্যে জমে ছিল। এ ঘটনায় আরো একবার মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল।’ অন্যদিকে রাজনৈতিক উত্তেজনাকে রাজনীতির মাধ্যমেই সমাধান করা উচিত বলে মনে করছে জামায়াতে ইসলামী। কোনো অবস্থাতেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়া কাম্য নয় বলেই মত দলটির। এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা বলছে, ‘গণহত্যার দায় স্বীকার না করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।’
তবে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুরের ঘটনা উল্টো গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের রাস্তা কেবল প্রশস্ত করবে বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার উসকানির ফাঁদে জড়িয়ে পড়লে অনভিপ্রেত, অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে একদিকে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শক্তি শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের অর্জন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাবে।’
ওবায়দুল কাদেরের বাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ :
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ‘প্রায় তিন শতাধিক বিক্ষুব্ধ লোকজন ওবায়দুল কাদেরের বাসভবনে ভাঙচুর চালায়। এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা বাসার ভেতরে থাকা বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এসময় জানালার কাচ ভেঙে ফেলেন তারা। কয়েকটি ফ্যান ও আসবাব লুট করে নিয়ে যায় জনতা। একপর্যায়ে কক্ষের ভেতরে থাকা কিছু আসবাব ভেঙে ঘরের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এসময় ‘কাউয়া’ ‘কাউয়া’ সহ বিভিন্ন সেøাগান দিতে দেখা যায়।’
গুঁড়িয়ে দিল আমু-হাসানাত আব্দুল্লাহর বাড়ি : বরিশালে সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও সাবেক চিফ হুইপ হাসানাত আব্দুল্লাহর বাড়ি এক্সকেভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে প্রথমে নগরের কালীবাড়ি রোডে থাকা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর বাড়ির গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েন উত্তেজিত জনতা। পরে সেনা সদস্যদের বাধা উপেক্ষা করে বাড়িটি এক্সকেভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে হামলার আশঙ্কা থেকে বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল সেনা সদস্যরা। সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকায় ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসভবনে ভাঙচুর শুরু হওয়ার পর রাত ১১টার দিকে হাসনাত আব্দুল্লাহর বাড়ির সামনে গিয়ে অবস্থান নেয় সেনা সদস্যদের একটি দল। রাত পৌনে ১২টার নাগাদ কয়েকশ মানুষ সেখানে গিয়ে সেনা ব্যারিকেড ভেঙে বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। পরে এক্সকেভেটর এনে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর এক্সকেভেটর নিয়ে নগরের বগুড়া রোডে থাকা সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর বাড়িতে গিয়ে ভাঙচুর করা হয়। সেখানেও পুরো বাড়ির কাঠামো এক্সকেভেটর দিয়ে ভেঙে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাড়িতে আগুন :
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানীতে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে বাঘা উপজেলা সদর ও চারঘাটের দিক থেকে শতাধিক মোটরসাইকেলে বিক্ষুব্ধ লোকজন বাড়িটির সামনে যান। এরপর কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পরে বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ক্ষোভের আগুনে ভস্ম নাসিমের বাড়ি :
ফেনীর পরশুরামে প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করে আলিশান বাড়ি বানিয়েছিলেন দুর্নীতির বরপুত্র ফেনী-১ আসনের সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। বাড়িটি সব সময় কালোবাজারিদের দ্বারা জমজমাট থাকতো। সন্ধ্যা নামলেই বাড়তো সুন্দরী রমণীদের আনাগোনা। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মদের আড্ডা। চলত নর্তকিদের দিয়ে নাচ-গান। স্থানীয়রা এটার নাম দিয়ে দিয়েছিলেন ‘পাপের বাড়ি’। কারণ এখানে চলত পাপাচার। আর বাড়িটি করা হয়েছিলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায়। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা নাসিমের পাপের বাড়ির আশপাশে জড়ো হতে থাকে। পরে রাতে সেখানে মানুষের ঢল নামে। একপর্যায়ে সেখানে গেট ভেঙে বাড়িতে ঢুকে পড়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। তাদের অনেককে দরজা-জানালা খুলে ফেলতে দেখা যায়। এসময় জানালার কাচ ভেঙে ফেলা হয়। অনেককে ভবনের ইট খুলে নিতেও দেখা যায়। পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সেখানে আগুন দেয়।
সাবেক এমপি শিমুলের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ :
নাটোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালিয়ে বিক্ষোভ করেছে ছাত্র জনতা। গত বুধবার দিবাগত রাত বারোটার দিকে একটি মিছিল গিয়ে শহরের কান্দিভিটা এলাকায় শিমুলের বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে আগুন দেয়। সদর থানার ওসি মাহাবুর রহমান জানান, ‘আসলে বাড়িটিতে তো কিছুই নেই। খবর পেয়েছি সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাসহ অন্যান্য লোকজনও রয়েছে। ডিজে পার্টি করছে শুনেছি।’
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হানিফের বাড়ি :
কুষ্টিয়ায় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহবুবউল আলম হানিফের বাড়ি। গত বুধবার রাত ১০টার পরে শহরের পিটিআই সড়কের বাড়ির সামনে মশাল মিছিল নিয়ে ছাত্র-জনতা অবস্থান নিয়ে ভাঙচুর শুরু করেন। পরে একটি বুলডোজার নিয়ে প্রথমে বাড়ির প্রধান ফটক ও বাউন্ডারি ওয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ছাত্র-জনতা সেøাগান দিতে থাকে ‘স্বৈরাচারের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’। হানিফের বাড়ির সামনে অনেকেই ভিড় করে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি।
কুমিল্লায় বাহারের বাড়ি ও অফিসে আগুন-ভাঙচুর :
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার খবরে বুধবার রাত ৯টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কুমিল্লা নগরীতে রাস্তায় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এর পরপরই রাত ১২টার পর থেকে কুমিল্লা সদরের সাবেক এমপি বাহার, আওয়ামী লীগ নেতার দোকানসহ অফিস ভাঙচুর ও আগুন জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা এ ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আদর্শ সদর উপজেলা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নিয়াজ পাভেলের শাসনগাছা এলাকার ব্যক্তিগত অফিস, দোকান ও লেবার শেডে হামলা হয়েছে। এ সময় রাস্তায় আগুন দেয়া হয়।
রাবিতে মুজিব পরিবারের নাম মুছে নতুন নামকরণ :
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আবাসিক হল ও অ্যাকাডেমিক ভবনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থাপনায় মুজিব পরিবারের নাম মুছে দিতে শিক্ষার্থীদের ভাঙচুর ও বিক্ষোভ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিজয়-২৪’ নামকরণ করেন তারা। এদিকে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা হল, কামরুজ্জামান হল, শেখ রাসেল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে থাকা নাম ফলক ভেঙে ফেলেন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসজুড়ে থাকা মুজিব পরিবারের নামে গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখন মুছে ফেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। এ সময় শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে ফাতিমা আল ফাহরিয়া ও কামরুজ্জামান হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদ আলি রায়হান হল এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নাম পরিবর্তন করে নবাব ফয়জুন নেসা চৌধুরানী, শেখ রাসেল মডেল স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কনিষ্ঠ শহীদ রিয়া গোপ নামকরণ করেন শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ মুজিবের ম্যুরাল, নামফলকসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস ও বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস