দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে স্থাপন করা ভূজপুর রাবার ড্যামটি হালদা নদীর বিষফোঁড়া। কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ নানা পরিকল্পনা নিয়ে ২০১২ সালে এই ড্যামটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু ড্যামটি কৃষিকে সমৃদ্ধ করতে পারছে না। এখনো আগের মতোই শ্যালো মেশিন ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে সেচের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এতে বাড়তি জ্বালানি খরচ গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। এছাড়া ড্যামের নিচের দিকে ১০ কিলোমিটার অংশে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু অংশে হালদা শুকিয়ে চৌচির হয়েছে। এতে ব্যহত হচ্ছে ড্যামের নিচের অংশের কৃষি উৎপাদন এবং নষ্ট হচ্ছে হালদার জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। উৎপাদন কমছে মাছের পোনার।
কৃষকেরা জানান, রাবার ড্যামটি চালু হওয়ার এক যুগেও নিরবিচ্ছিন্ন পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়নি। এ কারণে রাবার ড্যামটি কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অথচ পূর্ব ভূজপুরের আমতলি বিল, আড়ালিয়া বিল, হরিণাকুল, পূর্ব খৈয়া পুকিয়া বিলে বোরোখেতে সহজলভ্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যই হালদা নদীতে ড্যামটি স্থাপন করা হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), ফটিকছড়ি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে উপজেলার ভূজপুর ইউনিয়নের আমতলি এলাকায় রাবার ড্যাম স্থাপন করে এলজিইডি। ওই বছরের মার্চে ড্যামটি চালু করা হয়। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ধরা হয় প্রায় আট কোটি টাকা। হালদা নদীতে নির্মিত ড্যামটি দৈর্ঘ্যে ১০০ মিটার ও প্রস্থে ৪ দশমিক ৫ মিটার।
উপজেলা ভূজপুর ও নারায়ণহাট ইউনিয়নের ৫০০ হেক্টর বোরো ধানের জমি সহজ আবাদের লক্ষ্যেই ভূজপুর রাবার ড্যামটি স্থাপন করা হয়েছিল। পাশাপাশি উজানের অংশের শাখা খাল ও ছড়া সংস্কার করে পানি জমিয়ে রেখে কম খরচে বোরো আবাদ ও পাশবর্তী ৪ টি চা বাগানের সেচ সুবিধা দেয়া ছিল অন্যতম লক্ষ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ড্যামটির নিচের অংশে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে হালদা শুকিয়ে চৌচির হয়েছে। উপজেলা পাইন্দংয়ের ফকিরাচান বিল, ভূজপর আমতলী বিলের কিছু অংশ ও হারুয়ালছড়ির ফটিকছড়ি বিলে পানি না পেয়ে বোরো আবাদ হয়নি প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে। এতে কৃষকের লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বেশি। রাবার ড্যামের ফলে মাছের ডিম সংগ্রহ ও পোনা উৎপাদনও কমে যাচ্ছে দিনদিন।
স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের দাবী, ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে সহজশর্তে পানি ব্যবহারের জন্য। উল্টো কৃষকদের জিম্মি করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কানিপ্রতি ১৫ শ টাকা করে। এতে কৃষকের লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বেশি।
এ ব্যাপারে পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান চৌধুরী শিপন বলেন, ‘কৃষকের পানি সেচ সুবিধা দিতে অনেকগুলো মেশিন বসানো হয়েছে। এসবের বাড়তি খরচ মেটাতে এবছর কিছু টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। যা আগামী বছর থেকে কমে যাবে।’
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে হালদা নদী থেকে মাছের ডিম আরহণ হয়েছে ১ হাজার ৮৪০ কেজি। এক বছর আগেই এর পরিমাণ ছিলো ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি। গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ডিম আহরণ হয়েছে ২০২৪ সালে। একইভাবে ২০২০ সালে রেণু উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো ৩৯২ কেজি। ২০২১ ও ২০২২ সালে এর পরিমাণ কিছুটা কমলেও ২০২৩ সালে উৎপাদন হয় ৪৩৬ কেজি। ২০২৪ সালে আহরণ হয় মাত্র ৪৬ কেজি।
উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘হালদা উপর নির্মিত রাবার ড্যাম হালদার ক্যান্সার। এই ড্যামের ফলে পানিপ্রবাহ একদম কমে গেছে। ড্যামের নিচে ভূজপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, নাজিরহাট পৌরসভা অংশে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ একদম শুণ্যের কোটায়। হালদা বাঁচাতে ড্যামটি সরাতে হবে।’
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘ডিম আহরণ, রেণু ও মাছ উৎপাদনে ধসের পাশাপাশি রাবার ড্যামের কারণে বিলীন হতে বসেছে হালদা নদীর অস্তিত্ব। নদীর বড় একটি অংশে নেই পানির চিহ্ন। পরিণত হয়েছে ধুঁ ধুঁ বালুচরে। এতে প্রতিবেশগত ক্ষতির পাশাপাশি হালদার জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে পড়ছে।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘হালদা নদী জাতীয় সম্পদ। এটি রক্ষায় সবাইকে কাজ করতে হবে। রাবার ড্যামটি কৃষি উন্নয়নের জন্য স্থাপন করা হয়েছে। এটির লাভক্ষতি নিরূপণে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্রের এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহন করা জরুরি।’
কেকে/ এমএস