দায়িত্ব গ্রহণের পর ছয় মাস পেরিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতায় আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আশার বাণী শোনালেও এই ছয় মাসে তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, ধর্ষণ, হামলা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেকাংশে বেড়ে গেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কমেনি বরং বাড়ছেই। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।
রাজধানীর পল্লবীর টেকেরবাড়িতে গত ২০ জানুয়ারি দিনে-দুপুরে ১০ থেকে ১২ দুর্বৃত্ত মঞ্জুরুল ইসলাম বাবু নামের এক যুবককে চাপাতি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। বাবুর স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এ হত্যায় কলকাঠি নাড়েন সন্ত্রাসী মুসা শিকদার ওরফে সুমন শিকদার। এ ঘটনায় মুসাকে প্রধান আসামি করে পল্লবী থানায় মামলাও করেন বাবুর স্ত্রী। মুসার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্রসহ ১১টি মামলা রয়েছে। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বের হন মুসা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসার মতো চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে এসেই ফের জড়াচ্ছেন অপরাধে। এতে বাড়ছে খুনোখুনি। আধিপত্য বিস্তার, চাঁদার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যেও সংঘাতে জড়াচ্ছে তারা। বছরের শুরুতেই গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে স্বর্ণ ব্যবসায়ী সজল রাজবংশী আহত হন। তার কাছ থেকে ৭০ ভরি স্বর্ণ ও চার লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর আগে ২১ জানুয়ারি গুলশানে ব্যবসায়ী দুই ভাইকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে এক কোটি টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। রাত ৯টার দিকে গুলশান-২ এ হামলার শিকার হন তারা।
এরও আগে ১০ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে এহতেশামুল হক নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ওয়াহিদুল হাসান নামের আরেক ব্যবসায়ীর ওপর একই সময়ে হামলা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এহতেশামুলকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় অন্তত ২০ জন জড়িত ছিলেন। তারা এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেটসহ আশপাশের এলাকার বিপণিবিতান, ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভির সংযোগ (ডিশ) ও ফুটপাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। এ ঘটনায়ও জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম সামনে আসে।
সম্প্রতি দখল, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনির ঘটনায় কয়েকজনের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। তাদের মধ্যে ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ক্যাপ্টেন ইমন, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস ও সুব্রত বাইন, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। তারা সবাই কারামুক্ত হন ৫ আগস্টের পর।
জামিন বাতিলের আবেদন করবে ডিএমপি : ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, জেল থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নানা ধরনের অপকর্মে জড়াচ্ছে। তাদের জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করা হবে। কদিন আগেও দেখলাম ‘বেনজীরের ক্যাশিয়ার’খ্যাত জসিম জামিন পেয়েছেন। সুব্রত, পিচ্চি হেলাল ও ইমনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত খবর বেরোচ্ছে। আধিপত্য নিয়ে তারা বিরোধে জড়াচ্ছে। তাদের নানা অপকর্মে জড়ানোর তথ্যও পাচ্ছি। রেকর্ড হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। তাদের পেলেই আমরা ধরে ফেলব। কাউকে ছাড় দেব না। আপাতত আমরা তাদের জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করব। এ ছাড়া দাগি এসব অপরাধীর ব্যাপারে ইমিগ্রেশনে তথ্য দেওয়া হবে।
৫ মাসে খুন ১ হাজার ৫৬৫ : পুলিশ সদর দফতরর এক বছরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২৪ সালে তিন হাজার ৪৩২ জন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ খুনের ঘটনায় মামলা হয়। এর মধ্যে পেশাজীবীর সংখ্যা বেশি। সবচেয়ে বেশি খুন হয় ঢাকা রেঞ্জ এলাকায় ৮০৩ জন। এরপর চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৫৭০ জন, রাজশাহী রেঞ্জে ৩৪৩ জন এবং রাজধানী ঢাকায় খুন হয় ৩৩৯ জন। আর গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে খুনের সংখ্যা এক হাজার ৫৬৫ জন। এর আগের সাত মাসে খুন হয় এক হাজার ৮৬৭ জন। ২০২৪ সালে প্রতি মাসে গড়ে খুনের সংখ্যা ২৮৬ জন। যদিও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেক আগের বছরের খুনের ঘটনায় মামলা করেন ভুক্তভোগীরা।
চার মাসে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের অন্তত ৮০০ মামলা : পুলিশের অন্য এক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে দেশে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৭৯৬টি মামলা হয়েছে। আগের বছর ২০২৩ সালে একই সময়ে এ অপরাধে মামলা হয় ৪৯৪টি। একই সময়ে অপহরণের ঘটনায় ৩০২টি মামলা হয়। ২০২৩ সালের এ সময় এসব অভিযোগে মামলা হয় ১৬০টি। পুলিশ সদর দফতর বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সাধ্যমতো কাজ করছে। কিন্তু কিছু সামাজিক অপরাধের কারণেই খুনের পরিসংখ্যান বাড়ছে।
সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি এক দিনেই তিনটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরের দিয়াবাড়ী সিটি বস্তিতে মো. মিলন নামের এক পোশাককর্মীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিনে রাত সাড়ে ৯টায় খুলনা নগরের তেঁতুলতলা মোড় এলাকায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ণব কুমার সরকারকে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে ওই দিন দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজানে জুমার নামাজে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হন।
কারাগার থেকে পলাতক ৭০০ বন্দি এখনো অধরা : কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানান, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন কারাগার থেকে পালানো বন্দিদের মধ্যে এখনো ৭০০ জন বন্দি পলাতক। তারা খুন, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে মাঠ পুলিশের দূরত্ব : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে যে মাত্রায় স্বাভাবিক হওয়ার কথা বা জনগণ প্রত্যাশা করে সেই মাত্রায় স্বাভাবিক এখনো হয়নি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অগ্রগতি আছে, তবে তা পরিমাপ করাও কঠিন। গণঅভ্যুত্থানে পুলিশকে যেভাবে দেখেছি তাদের আইনগতভাবে ও মানুষের অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল। সে জায়গা থেকে তাদের নৈতিক ও মনোবল সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কারণ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের দূরত্ব আছে। এ কারণেই সংকট কাটাতে সময় লাগছে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের বাস্তবতায় আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হলে সেই দায় কেউ নিতে চাইছে না। বাহিনী হিসেবে দায় না নিয়ে পুলিশ ব্যক্তি হিসেবে দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। এটি পেশাদারত্বের পরিপন্থি। এজন্য আইন ও কর্ম ঘণ্টার মধ্যে একজন পুলিশ ওইটুকুই দায়িত্ব পালন করছে কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। এ ছাড়া মাঠপর্যায় ও নীতিনির্ধারণী পর্যায় এখনো পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, অতীত চরিত্র থেকে পুলিশের অনেকেই নিজেকে বদলাতে পারেনি। মানসিকতা, অনৈতিক কিংবা অপেশাদারত্বমূলক সুযোগ-সুবিধা কিংবা আর্থিক সুযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সব পুলিশ মুক্ত হতে পারেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিজেদের সংশোধিত রূপে কাজ করার ঘাটতি রয়েছে। এ সুযোগে অপরাধীরা সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে।
ড. তৌহিদুল হক আরো বলেন, শীর্ষ পর্যায়ের অপরাধী যারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন আদালত চাইলে তাদের জামিনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। অপরাধীদের যে নজরদারিতে রাখা হয়নি তাদের দৌরাত্ম্য দেখলেই বুঝতে পারা যায়। সত্যিকার অর্থে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।
কেকে/এআর