কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পদ্মা নদীতে দুর্বৃত্তদের হামলায় দুই এএসআই নিহতের ঘটনায় আসামী ধরতে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ রাবার বুলেট ছুঁড়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে উপজেলার কয়া ইউনিয়নের কালোয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
আজ বৃহস্পতিবার(৩১ অক্টোবর) দুপুরে কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) নজরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে পদ্মায় পুলিশ ও ইউপি সদস্যদের উপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় দুইটি মামলা দায়ের হয়েছে। কুমারখালী থানায় দায়ের করা এই দুই মামলায় এখন পর্যন্ত ১০জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষ গ্রুপের হামলায় আসামী পক্ষের একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ তরুন শেখে(৪৫) কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ১নং ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি একই এলাকার মৃত মোশারফ শেখের ছেলে। তবে গুলির বিষয়ে কিছু জানে না বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, সকাল সাড়ে ৭টায় ওই এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার হাতে ও পায়ে গুলি লেগেছে। পুলিশকে জানানো হয়েছে। কি গুলি তারা বলতে পারবে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার দিবাগত রাতে মামলার আসামী ধরতে কালোয়া গ্রামে যায় পুলিশ। এসময় আসামী পক্ষের লোকজন একসাথে হয়ে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তাদের উপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ রাবার বুলেট ছুঁড়লে হামলাকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়া রামদা, হাসুয়া ও ঢাল উদ্ধার করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বলেন, পুলিশ বাদী মামলায় প্রধান আসামী ইয়ারুলের সহযোগী মাহাবুল বেড় কালোয়া গ্রামের কুদু শেখের বাড়িতে পালিয়ে ছিল। বিষয়টি জানতে পেরে গতকাল বুধবার ইয়ারুলের প্রতিপক্ষ গ্রুপের সাবেক ইউপি সদস্য খালেক মেম্বরের লোকজন মাহাবুলকে পুলিশকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ওই বাড়ি থেকে জোর করে নিয়ে যায়। এসময় কুদু শেখের লোকজনের সাথে খালেক মেম্বারের লোকজনের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। এ ঘটনার পর রাতে পুলিশ ওই এলাকায় গেলে আসামী পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়। পুলিশও পাল্টা শটগানের গুলি ছোঁড়ে। এসময় প্রতিপক্ষ গ্রুপের ইউপি সদস্য খালেক মেম্বারের লোকজন আসামী পক্ষের তরুন শেখকে হাতে-পায়ে গুলি করে।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কলোয়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ হত্যা মামলার প্রধান আসামী ইয়ারুল শেখ ও সাবেক ইউপি মেম্বার খালেক গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেরদিন ভোরে আওয়ামী লীগের বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রউফের সমর্থক খালেক মেম্বার গ্রুপের লোকজনের হামলায় পরাজিত নৌকার প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জের সমর্থক ইয়ারুলের ভাই জিয়ার নিহত হয়। তখন ওই হত্যা মামলায় খালেক মেম্বারসহ তার ছেলেদের আসামী করা হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ তরুন শেখ বলেন, একজন মানুষ জানের ভয়ে আমার চাচার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। অথচ খালেক মেম্বরের দুই ছেলে রিপন ও শিপনের নেতৃত্বে প্রায় ২০জন তাকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেই। বিষয়টি নিয়ে বাঁধা দিলে মেম্বরের ছেলেরা আমাদের রাতে দেখে নেওয়ার হুমকি দেই। রাত আনুমানিক ২টার দিকে ৭ থেকে ৮জন বাড়িতে ঢুকে আমার চাচাতো ভাই সোহানকে মারধর করতে থাকে। এসময় চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার হাতে ও পায়ে একজন শটগান দিয়ে ৫ রাউন্ড গুলি করে। অন্ধকারে আমি খালেক মেম্বারের দুই ছেলে, রিপন, শিপন, লিটন, জাহাঙ্গীর ও সেলিমকে চিনতে পেরেছি।
প্রত্যক্ষদর্শী আহতের চাচাতো ভাই আশরাফ শেখ বলেন, গুলির শব্দ শুনে আমি দৌড়ে পালাতে গেলে আমাকে ৩ থেকে ৪ জন ধাওয়া করে ধরে ফেলে। পরে আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। কোন রকম পালিয়ে বেঁচেছি।
এর আগে গত সোমবার ভোর চারটার দিকে উপজেলার বেড় কালোয়া এলাকার দুর্বৃত্তদের হামলায় নৌকা থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিখোঁজ হন। তারা হলেন- কুমারখালী থানার এএসআই সদরুল আলম ও এএসআই মুকুল হোসেন। এদের মধ্যে মঙ্গলবার বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে এএসআই সদরুল আলমের লাশ ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এবং গতকাল বুধবার সকাল সাতটার দিকে পাবনার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ এলাকায় পদ্মানদীতে ভাসমান অবস্থায় মুকুলের লাশ উদ্ধার করে নাজিরগঞ্জ নৌ পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা।
কুমারখালী থানা সূত্রে জানা গেছে, দুই এএসআই নিখোঁজের পরের দিন মঙ্গলবার কুমারখালী থানার এসআই নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ইয়ারুল শেখসহ ৮ জনকে এজাহারভুক্ত আসামী করা হয়। একই ঘটনায় কলোয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড সদস্য ছানোয়ার হোসেন সেলিম বাদী হয়ে ৩৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামী করে কুমারখালী থানায় আরেকটি মামলা করেন। দুইটি মামলাতেই আরো ২০ থেকে ২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে।
ঘটনার পর জেলা পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সোমবার(২৮ অক্টোবর) ভোর চারটার দিকে কুমারখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে ছয়জন পুলিশ সদস্য, স্থানীয় দুই ইউপি সদস্য ও দুই মাঝি মিলে পদ্মার ওপারে চরসাদীপুর এলাকায় আসামি ধরতে যাচ্ছিলেন। এসময় কয়েকটি নৌকার জেলেরা তাদের ওপর হামলা চালান। তখন প্রাণ বাঁচাতে দুই পুলিশ সদস্য নদীতে ঝাঁপ দেন। তবে স্থানীয় লোকজন বলেছেন, ভোরে স্থানীয় ইউপি সদস্যদের সহযোগিতায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য নৌকা নিয়ে পদ্মা নদীতে যান। এ সময় তারা জেলেদের মাছ লুট করার চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বেশ কয়েকটি নৌকার ১৫ থেকে ২০ জন লোক তাদের ওপর হামলা চালায়। ঘটনার পর থেকেই জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় জেলেদের নেতৃত্বে থাকা ইয়ারুল শেখের নাম প্রকাশ্যে আসে।
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, রাতে আসামী ধরতে গিয়ে আসামী পক্ষের লোকজন হামলার চেষ্টা করে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে আমরাও ফাঁকা রাবার বুলেট ছুঁড়েছি। হামলাকারীরা পালিয়ে যাওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। আলাদা মামলার প্রস্তুতি চলছে। তবে গুলিবিদ্ধের ঘটনা জানা নেই। এটা আলাদা কোন ঘটনা হতে পারে। এখন পর্যন্ত দুই মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
কেকে/এজে