রাজনীতি ক্রমশই ঘোলাটে হয়ে উঠছে। সরকার দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, কূটনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। আর সরকারের এমন ব্যর্থতায় ফায়দা লুটতে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে সরকারের সঙ্গে, নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় দেশে ভবিষ্যতে কী হয়, তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।
সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট হচ্ছে
রাষ্ট্র পরিচালনায় আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোরও কোনো অভিজ্ঞা ছিল না, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও নেই। তারপরও আগের যে কোনো অরাজনৈতিক সরকারের চেয়ে এ সরকারের ব্যর্থতা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ছয় মাস পরও চালসহ দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারেনি। তবে এখন সবজি, পেঁয়াজ, মরিচের দাম কম হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সয়াবিন তেল, মুরগি, মাছসহ অন্যান্য অনেক পণ্য এখনো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। সরকার পণ্যের সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে।
রফতানি ও প্রবাসী আয় বাড়ায় অর্থনীতি এখন কিছুটা ভালো মনে হয়। কিন্তু সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারেনি। অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়েছে। নতুন কারখানা ও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এভাবে চললে ভবিষ্যতে অর্থনীতি মারাত্মক সমস্যায় পড়বে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার অনেকটাই ব্যর্থ। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ মারা যাচ্ছে, ছিনতাই হচ্ছে, ডাকাতি হচ্ছে। পুলিশ এখনো স্বাভাবিকভাবে কাজে ফিরতে পারেনি। ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন জায়গায় নজিরবিহীন ভাঙচুর চালিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও নেতাদের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো এসময় দাঁড়াতে পারেনি, রক্ষা করতে পারেনি এসব বাড়িঘর।
ড. মোহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাবা হয়েছিল, কূটনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে তার সরকার। যেমন আসবে বিদেশি বিনিয়োগ, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন জোয়ার তৈরি হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনেক অগ্রগতি আশা করেছিল মানুষ। কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি, বরং মার্কিন সহায়তা বন্ধের পর তার আঁচ লাগতে শুরু করেছে। ইউএসএইড বন্ধ হওয়ায় অনেক মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ থেকে, এ পথ ধরবে ইউরোপের আরো অনেক দেশ।
রাজনৈতিক ঐক্য সুদূর পরাহত
গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাসের মধ্যে আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর মধ্যে চরম মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধীরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যস্ত। রাষ্ট্রপতি অপসারণ ও সংবিধান বাতিল প্রশ্নে তাদের সঙ্গে বিরোধ হয়েছে বিএনপির। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও বৈষম্যবিরোধীরা চাচ্ছে সংস্কারের পর নির্বাচন হোক। সবচেয়ে রহস্যময় অবস্থা জামায়াতে ইসলামির। তাদের পুরোনো মিত্র বিএনপিকে বাদ দিয়ে তারাই ক্ষমতায় আসার চিন্তা করছে। তারা এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলায় প্রার্থী ঘোষণা শুরু করেছে। একবার তারা সংস্কারের কথা বলছে, আবার তারা বলছে নির্বাচনের কথা। এক নেতা নির্বাচন দ্রুত দেওয়ার দাবি তুলছে, অন্য নেতা বলছে আগে সংস্কার করতে। একই রকম অবস্থা ইসলামি আন্দোলনেরও, বিএনপি-জামায়াত দুই দলের নেতারা তাদের সঙ্গে দেখা করার পর তারা চুপ হয়ে গেছে। বিএনপির মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের জাসদ (রব) নেতা আ স ম রব, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না এবং গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকি বিএনপির সুরে কথা বলছে। তারা সবার আগে নির্বাচন চায়। ভিপি নুরের পক্ষ থেকেও সংস্কারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সব মিলে এ দলগুলোর মধ্যে এখন ঐক্য বলতে কিছু নেই। সবচেয়ে বেকায়দায় বিএনপি, তারা নির্বাচনের কথা বারবার বললেও জোরালো আন্দোলন করার মতো পরিস্থিতি এখনো নেই।
ফায়দা নিতে এগোচ্ছে আ.লীগ
সরকারের অনবরত ব্যর্থতা আর বিএনপিসহ স্বৈরাচারবিরোধী দলগুলোর অনৈক্যের সুযোগ নিতে এগোচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা এখন বিচ্ছিন্ন মিছিল করতে শুরু করেছে। সবশেষ ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে তারা লিটলেট বিতরণে সাড়া ফেলেছে। অনেক গ্রেফতার হলেও দলটির বিশাল বড় আকারের তুলনায় তা নগন্য। হাজারো নেতা-মন্ত্রী এবং এমপি বিদেশে অবস্থান নিয়েছে। তারা বাংলাদেশে নানা কর্মসূচি সংগঠিত করছে। দলটির সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় আছে, তারা নিজেদের দলের পক্ষে নানা পোস্ট দিচ্ছে। এবারের আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগ নয়, তারা অত্যন্ত সুগঠিত। জেলায় জেলায় নেতাকর্মীরা সক্রিয় আছেন। যে কোনো সময় তারা জেগে উঠতে পারে, গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় দ্রুত নির্বাচন দিলেই কেবল মুক্তি, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে ঠিক হতে শুরু করবে অর্থনীতি-কূটনীতি।
কেকে/এআর