গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলমান। দেশি-বিদেশি ইন্ধনে অশান্ত দেশ। পতিত শক্তি আওয়ামী লীগও দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে মরিয়া। রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তীর্যক দৃষ্টি। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন পক্ষের এজেন্ট। প্রতিনিয়ত ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা।
এই যখন পরিস্থিতি তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামনে কঠোর সময় আসছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, দেশের জন্য এটা খুব জরুরি। কত ঘটনা ঘটে গেল, সামনে আরো বহু ঘটনা ঘটবে। যাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সহজে মেনে নেবে না।’
প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যকে সমর্থন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড। গত কয়েকদিনে এমন বেশ কিছু ঘটনা চাক্ষুস করেছে দেশবাসী। শেখ হাসিনার অনলাইন ভাষণ, ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস এবং বাড়িতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ; সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর এবং শেখ হাসিনার উসকানির জেরে গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যাপক মারধর; সবশেষ ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ একই সূত্রে গাঁথা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে দেশ থেকে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেই যাচ্ছে। আর বুঝে বা না বুঝে সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের সেই উদ্যোগে পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেটা তাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাকে প্রমাণ করে। অপরদিকে শিক্ষার্থী-সরকারের এই অজ্ঞতাকে ক্যাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে ক্যাশ করেছে পতিতরা।
তারা আরো বলছেন, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা বিশেষ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা কম বয়স এবং কম অভিজ্ঞতার এমন ভুল করতেই পারে; তবে সরকারের উচিত তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেটা না করে যদি ‘মব’ উসকে দেওয়া হয় তাহলে জাতির সামনে খুব কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের উৎখাতের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানে সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা যেন হাসিনার পাতা ফাঁদে পা না দেই। আজকে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, এর জন্য সম্পূর্ণভাবে হাসিনার যে ফ্যাসিস্ট রেজিম ছিল, সেই রেজিম তার জন্য দায়ী। আমাদের সাবধানতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে। আমাদের অর্জিত সফলতাকে সফল করতে হলে আমাদের ধীরে ধীরে এগোতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা অন্ধকারকে দূর করতে আরেকটা অন্ধকার দিয়ে দূর করা যায় না। তাকে আলো দিয়ে দূর করতে হয়। সেই আলোকবর্তিকা জাগিয়ে আমাদের সামনের দিকে যেতে হবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আহ্বান জানাতে চাই, সবাই একযোগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য, স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে।’
গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদ পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে বাংলাদেশকে আমরা নতুন বাংলাদেশ হিসেবে তৈরি করলাম, এটা যাতে সেভাবে রাখতে পারি। এটাকে হেলায় ফেলে দিলে হবে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের সার্বক্ষণিক সাবধান থাকতে হবে, নজর রাখতে হবে। সেই দায়িত্ব আমাদের সবাইকে মিলে নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশের ভেতরে যারা গণ্ডগোল সৃষ্টি করতে পারে তাদের নিশ্চিহ্ন করব আমরা। নিজেদের দলে নিয়ে আসব, না হলে আইনের কাছে সোপর্দ করে দেব। এটা হলে আমরা তাড়াতাড়ি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারব।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘বিচারের কাজ চলতে থাকুক, যারা অপরাধী পুলিশের কাছে দিয়ে দাও। যথেষ্ট সাক্ষী-প্রমাণসহ তুলে দিতে হবে, অবিচার যেন না হয়। আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই সংগ্রাম হয়েছে। আমরা যদি নিজেরা অবিচারে নেমে যাই তাহলে তফাৎ থাকল কী। আমরা অবিচারে নামব না। যারা অপরাধী তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করব। যারা অপরাধী নয় পুলিশের হাতে দেওয়ার মতো, তাদের মানুষ করব। আমরা একযোগে যত তাড়াতাড়ি পারি এটাকে একটা সুন্দর দেশ বানাব। যারা অপরাধী তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। যারা অপরাধী নয় তাদের সৎপথে নিয়ে আসতে হবে এ দেশে থাকার জন্য, একতার জন্য। আমরা যারা এখানে বসে আছি তারা যেন আলাদা না হয়ে যাই। দুঃখের কথা বলব, কিন্তু বিবাদ সৃষ্টি যেন না হয়।’
আবার রাজনৈতিক বিশ্লষকদের কেউ কেউ বলছেন, এটা শুধু কম অভিজ্ঞতার বিষয় নয়। এখানে একটা তীক্ষ্ম ষড়যন্ত্রও বিদ্যমান। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ভেতর বিভিন্ন পক্ষের এজেন্ট ঢুকে গিয়েছে। তারাই সরকার এবং বৈষম্যবিরোধীদের বিপদে ফেলতে নানা বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। যার ফসল উঠছে পতিত আওয়ামী লীগের ঘরে।
কেকে/এআর