দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিশেষ করে হাসিনা সরকারের আমলে দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় মাঠ পর্যায়ে প্রকাশ্যে সংগঠনটিকে তেমন একটা চোখে পড়েনি। তবে অবস্থান ধরে রাখতে নানা কৌশলে চলেছে দলীয় কার্যক্রম।
এর মাঝে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশে শুরু হয় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। সব বাধা পেরিয়ে জামায়াতে ইসলামীও ব্যাপকভাবে শুরু করে মাঠ গোছানোর কাজ।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে শুরু আলোচনা। প্রথম দিকে সব রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের তাগিদ দিলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তোলেন। সংস্কার ও নির্বাচন একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার কথা জানায় বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলের গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই প্রয়োজন।’
তবে নির্বাচনের আগে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছিল জামায়াত ইসলামী। এমনকি এ নিয়ে তাদের এক সময়ের মিত্র ও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গেও তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। সংস্কার নাকি নির্বাচন এই আলোচনা যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময়ে সারা দেশে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী ঘোষণা করছে জামায়াত। এ নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত একদিকে সংস্কারের প্রতি জোরালো হলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে মাঠ পর্যায়ে। যা দৃশ্যমান হয়েছে বিভিন্ন আসনে প্রার্থী ষোষণার মধ্য দিয়ে।
বিশ্লেষকরা আরো মনে করেন- বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী কিছু এলাকায় শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও অধিকাংশ অঞ্চলে দলটির সাংগঠনিক কাঠামো এখনো দুর্বল। দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চায় সংগঠনকে আরো কার্যকর ও সক্রিয় করতে। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিটি এলাকায় জামায়াতের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি। অন্যদিকে, বিএনপি সারা দেশের প্রতিটি নির্বাচনি এলাকাতেই একটি সুসংগঠিত দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিএনপির রয়েছে মাঠপর্যায়ে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ও ব্যাপক কর্মীসংখ্যা, যা রাজনৈতিক ময়দানে দলটিকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। আর এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই জামায়াতের নেতৃত্ব মনে করছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিটি অঞ্চলে সাংগঠনিক অবস্থান তৈরি করা সম্ভব। দলটি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সেইসব এলাকা যেখানে তাদের উপস্থিতি দুর্বল কিংবা যেখানে এতদিন আওয়ামী লীগ শক্তিশালী বলে বিবেচিত হয়ে আসছিল। তাই জামায়াত এসব অঞ্চলে আগেভাগেই সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করছে, যাতে তারা মাঠপর্যায়ে সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার করতে পারে এবং রাজনৈতিকভাবে একটি দৃশ্যমান অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়।’
এ নিয়ে কথা হয় জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার-মিডিয়া সেক্রেটারি অ্যাড. মতিউর রহমান আকন্দের সঙ্গে। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী যে সংস্কারের কথা বলছে, সেটা নির্বাচনের জন্যই বলছে। বিষয়টি এমন নয় যে- সংস্কার হোক; কিন্তু নির্বাচনের দরকার নেই। বরং আমাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- নির্বাচনের জন্য সংস্কার করতে হবে। আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে নির্বাচন।’
জামায়াত ইতোমধ্যে সারা দেশে প্রার্থী ঘোষণা করছে জানিয়ে অ্যাড. মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘জামায়াত অলরেডি সারা দেশে নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। তিনশ আসনে আমাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলেছি। সুতরাং আমরা তো নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমে পড়েছি। আর আমাদের সংস্কার দাবিটা হচ্ছে এজন্য যে- এ পর্যন্ত ১২টা সংসদ নির্বাচন হয়েছে; এতে বাংলাদেশের কী পরিবর্তন হলো? কিছুই পরিবর্তন হয়নি। তাই আপনাকে সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। ইলেকশন, জুডিশিয়ারি, প্রশাসন, প্রশাসনিক কাঠামো ও প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ এগুলোর একটা ফায়সালা হতে হবে। আমরা প্রস্তাব করেছি দুই বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভারসাম্যতা আনতে হবে। এগুলো সুরাহা না করে যদি নির্বাচন হয় তাহলে বাংলাদেশ তো সেই আগের জায়গায়-ই ফিরে যাবে। ফলে আমরা নির্বাচনের আগেই যেনো সবগুলো সংস্কার হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিয়েছি। সুতরাং আমরা সংস্কারও চায় আবার নির্বাচনও চায়। জামায়াত নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।’
জামায়াত সংস্কার আলাপের মধ্যে এতোদিন ভেতরে ভেতরে দল গোছাচ্ছিল কিনা জানাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভেতরে ভেতরে কার্যক্রম চালানোর কিছুই নেই, যা হচ্ছে সবই প্রকাশ্য। সংস্কারের দাবি এটাও যেমন প্রকাশ্য, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রার্থী ঘোষণা এটাও প্রকাশ্য। মাঠে প্রার্থীরা কাজ করছে এটাও প্রকাশ্য। কাজেই আমাদের কোনো কিছুই আড়াল নেই, সবকিছুই প্রকাশ্যে হচ্ছে।’
এর আগে মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটা ‘নির্বাচনের জেনোসাইড’ হবে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। মৌলিক কিছু সংস্কার করা না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় নির্বাচন দেওয়া হলে এটা হবে নির্বাচনের জেনোসাইড বা নির্বাচন গণহত্যা। আমরা এটা চাই না। আমরা চাই সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির পর নির্বাচন।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘জামায়াত এখনো অফিশিয়ালি প্রার্থী ঘোষণা করেনি, এটা প্রাথমিক সিলেকশন। ইলেকশন এখনো অনেক দূর। ইলেকশন কাছে এলে দল ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবে। তখন যাদের নমিনেশন দেবে, তারাই প্রার্থী হবেন।’ গত রোববার বিকালে সিলেট নগরের দরগাগেট এলাকার কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের শহীদ সুলেমান হলে আয়োজিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির এ কথাগুলো বলেন। সিলেট মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে এই শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়।
কেকে/এআর