অবশেষে দেশে বাজতে শুরু করেছে নির্বাচনি দামামা। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসকে হিসাবে ধরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। এমন তথ্যই জানাচ্ছে রাষ্ট্রের নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। গত সোমবার বিএনপির সঙ্গে বৈঠকেও সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করেছেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। গতকাল নির্বাচন কমিশনে ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সহযোগী ১৮টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর বাইরে এ মুহূর্তে অন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি ইসি নিচ্ছে না। তবে সরকার চাইলে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে ইসি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা ১৬ ডিসেম্বরের বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যদি অল্প পরিমাণে সংস্কারসহ নির্বাচন করতে হয় এবং সেখানেই যদি রাজনৈতিক মতৈক্য গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে পরে এ বছরের শেষ নাগাদ ডিসেম্বর ২০২৫-এ ইলেকশন। আর যদি আরেকটু সংস্কার করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে ২০২৬-এর জুন নাগাদ ইলেকশন করা সম্ভব।’ নির্বাচন কমিশন আগের তারিখটা ধরেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়ে কমিশনের অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত।”
এর আগে গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে রাত পৌনে আটটায় যমুনা প্রাঙ্গণে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সঙ্গে যারা ছিলেন তারা আশ্বস্ত করেছেন, অতিদ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন। জনগণের প্রত্যাশা, অতিদ্রুত একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে, যার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে।’ কবে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হতে পারে, এমন এক প্রশ্নে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এটা ওনারা ঠিক করবেন। তবে ওনারা সম্ভাব্য ১৫ তারিখের (ফেব্রুয়ারি) মধ্যেই কিছু একটা বলতে পারেন।’
দেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শুরু থেকেই দ্রুত নির্বাচন দিতে সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল বিএনপি। নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণাসহ কিছু দাবিতে আজ বুধবার থেকে মাঠের কর্মসূচিতে যাচ্ছে দলটি। এ কর্মসূচি শুরুর আগে সোমবার সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে তাগিদ দিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এর আগে গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। সে বৈঠকে ইসির কাছে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন নেতারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে আর কোনো রাখঢাক নেই। এ বিষয়ে সরকারপ্রধানকে দলীয় অবস্থান জানিয়েই তারা কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। ১২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে সমাবেশ করবে বিএনপি। বিএনপির নেতারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো, নির্বাচনের রোডম্যাপ এবং ফ্যাসিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও কার্যত ‘নির্বাচনের রোডম্যাপের’ দাবিতেই সমাবেশ করা হচ্ছে।
এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসনগুলোতে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা দেওয়া শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। অন্যদিকে ‘নির্বাচনের আগে সংস্কারকে’ অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কথা বলছে দলটি।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দলীয় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তাদের দল যোগ্য প্রার্থী বের করতে একটি বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তবে কেন্দ্র থেকে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করিনি।’
পাশাপাশি দেশজুড়ে দলীয় ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করছেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। এসব সফরে কর্মিসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখেই দেশের ছয়টি জেলার অন্তত ৩২টি আসনে এখন পর্যন্ত জামায়াতের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণার তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলছেন, ‘নির্বাচনের সময় ঠিক করার পর সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি ভালো ভোটার তালিকা করে সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। নির্বাচনের আগে পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, ‘ইসলামি আন্দোলনকে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার তৌফিক আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। ইসলামি আন্দোলনকে ছোট মনে করলে হবে না। যখন ইসলামের বিরুদ্ধে ও দেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র তৈরি হয় তখন এর প্রতিবাদে ইসলামী আন্দোলন রাজপথে আওয়াজ তুললে অপরাধীদের কলিজা থরথর করে কেঁপে ওঠে।’ গতকাল মঙ্গলবার পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে উপজেলার রাঙ্গাবালী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে সংঘটিত গণহত্যার বিচার, দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
গতকাল মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার। বৈঠক শেষে তিনি বলেছেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা সহযোগিতা করছি। আশা করছি এবার নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা।
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন হবে, তা সব রাজনৈতিক দলের চাওয়ার ওপর নির্ভর করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা আগেই দুটি সময়ের কথা বলেছেন। একটি চলতি বছরের ডিসেম্বর, অন্যটি সামনে বছরের জুন। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে। এখন যদি সব পার্টি মিলে বলে যে না, আমরা ডিসেম্বরেই চাই। প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন, এমন না যে উনি একটা জায়গায় স্থির আছেন। আমি জুনেই নির্বাচন করব এ রকম তো আর উনি বলেননি। এটা হচ্ছে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর কী প্রত্যাশা, তারা কী চায়; সেটার ওপরেই মূলত নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করবে।’
উল্লেখ্য, গত পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ সরকার গঠিত হয়। তবে গণঅভ্যুত্থানের পর এই ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ নানা বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জন্য রোডম্যাপ প্রকাশ করতে ব্যাপক চাপ দিচ্ছিল বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে দল গোছাতেও শুরু করেছে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল।
কেকে/এআর