একে তো রোগের যন্ত্রণা; তার ওপর চিকিৎসার খড়্গ। প্রথমেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে পান এক প্রেসক্রিপশন। তাতে লেখা কিছু ওষুধ আর টেস্ট। ওষুধ কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস; টেস্ট করাতে গিয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থা। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। এর নেপথ্যে যে একশ্রেণির চিকিৎসকের লোভ ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর অতিমুনাফার কালো অধ্যায় লুকিয়ে, তা ওই অসহায় রোগীর অজানাই থেকে যায়। জানা যায় শুধু ডাক্তারদের উপঢৌকন বন্ধ হলেই ওষুধের দাম কমবে প্রায় ৩০ শতাংশ।
দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বিপণন কার্যক্রমের নামে বছরে বড় একটা অঙ্গের টাকা ডাক্তার, মেডিকেল প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করছে। অথচ ওষুধের গুণগত মান ও কার্যকারিতায় কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। ফলে সচেতনতার অভাবে ক্রেতারা ওষুধ সম্পর্কে অন্ধকারে থাকছেন। ওষুধ কিনে ভয়ংকর প্রতারণার শিকার হলেও তাদের কোনো প্রতিকার পাওয়ার পথ নেই।
ওষুধ কোম্পানি প্রভাবিত ডাক্তারদের ওপরই তাদের শতভাগ নির্ভর করতে হচ্ছে। বিভিন্ন অসুখে মানুষ পুরোনো প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ কিনে বিপদে পড়ছেন। অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলো অনৈতিক মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে ডাক্তারদের ফ্রিজ, টিভি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, বিদেশ ভ্রমণ, নগদ টাকা দিয়ে পুরো ওষুধ বাজারকে প্রভাবিত করছে। এ অরাজকতা বন্ধে প্রতিটি ওষুধের গুণতম মান ও কার্যকারিতা নিয়ে জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারণা প্রয়োজন, যাতে মানুষ যেন নিজের বুদ্ধি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জেনে বুঝে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করতে পারেন। কারণ, ওষুধ কোম্পানি প্রভাবিত ডাক্তাররা রোগীদের সচেতনতার অভাবে ইচ্ছামাফিক অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশন ভারী করছেন। এতে ওষুধ কোম্পানির অনৈতিক মুনাফা এবং ডাক্তারদের রোজগার বাড়লেও কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
উপঢৌকন বন্ধ হলে ওষুধের দাম কমবে ৩০ সতাংশ: শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। বেলা ১১টা। বহির্বিভাগের ডাক্তারের কক্ষ থেকে কোনো রোগী বের হলেই তাকে ঘিরে ধরছেন বেশ কয়েকজন মানুষ। হুমড়ি খেয়ে তার হাতের প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন তারা। কথা বলে জানা যায়, তারা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। ছবি তোলার কারণ, নিজেদের কোম্পানির ওষুধ চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে লিখেছেন কিনা, সেটা যাচাই করে দেখা। প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সে ছবি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও পাঠিয়ে দেন।
কেবল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেই নয়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের কক্ষ থেকে রোগী বের হওয়া মাত্রই প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার দৃশ্য এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর এর কারণ হিসেবে জানা যায়, নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য ডাক্তারদের কোম্পানির পক্ষ থেকে নিয়মিত দামি দামি উপহার এবং নগদ টাকাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে একক বা দলগতভাবে ভ্রমণ কিংবা সেমিনারে অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও করে ওষুধ কোম্পানিগুলো।
একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক পর্যায়ের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন অধিকাংশ চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে নানা রকম সুবিধা নিয়ে থাকেন। এসব নিয়ে আর কী বলব! যারা এমন করছেন তারা আমাদেরই ছাত্র, ভাই-বন্ধু ও সহকর্মী। আবার সৎ ডাক্তার যে একেবারে নেই, তা নয়। কোনো কোম্পানি নগদ খাম দেয়, কেউ দামি উপহার দেয়, কেউ হয়তো ডাক্তারদের পরিবার-পরিজনদের দেশে-বিদেশে ট্যুরের টাকাও দেয়।
গত কয়েক মাস থেকে দেশে ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ। স্বল্প আয়ের মানুষ বাড়তি মূল্যে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে জনসাধারণের মনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকদের মধ্যে চলা প্রমোশনের নামে অনৈতিক লেনদেন। কারণ, ডাক্তারদের দেওয়া টাকা বা উপহার কোনো কোম্পানিই নিজেদের পকেট থেকে দেয় না। ওষুধের দাম বাড়িয়ে সেই টাকা ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করা হয়। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রমোশন কিংবা মার্কেটিংয়ের নামে ডাক্তারদের যে অনৈতিক সুবিধা দেয়, তা বন্ধ করা গেলে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে ওষুধের দাম অনেকটাই কমানো সম্ভব।
ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের উপহার দেওয়ায় প্রবণতা বন্ধ হলে ওষুধের দাম কমতে পারে কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাব্বির হায়দার বলেন, প্রমোশনের নামে চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহার, টাকা-পয়সা দেওয়াসহ অনৈতিক সব ব্যয় ওষুধের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই মূল্য ভোক্তাকেই পরিশোধ করতে হয়। কোম্পানি অযৌক্তিক এসব ব্যয় কমালে ওষুধের মূল্য বেশ কমে আসবে।
ওষুধ কোম্পানি এবং ডাক্তারদের অনৈতিক সুবিধা আদান-প্রদান বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, এটাকে আমরা বলি অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং। ওষুধের দাম যদি সরকারের প্রাইসিং ফর্মুলার ভিত্তিতে হয়, তাহলে কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মূল্য নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। অতিরিক্ত মূল্য যখন নিতে পারবে না তখন ওষুধ কোম্পানির সারপ্লাস থেকেই অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের খরচ বহন করতে হবে। তখন তারা এ অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং থেকে সরে আসবে।
তিনি আরো বলেন, এখন যেহেতু কোম্পানি নিজেরাই দাম নির্ধারণ করে, তাই দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে ডাক্তারকে ৮ টাকা দিলে তো তাদের ক্ষতি নাই। তারা যেহেতু দাম নির্ধারণ করে তাই তারা এটা করতে পারছে। কিন্তু দাম যখন সরকারের অথরিটি নির্ধারণ করবে, তখন এটা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সব ধরনের ওষুধের দাম ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। এজন্য একটা জাতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি তৈরি করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ডাক্তারদের যেমন নৈতিকতা মেনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া উচিত ঠিক তেমনি ওষুধ কোম্পানিগুলোকেও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করা উচিত। যদি ওষুধ কোম্পানিগুলো নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করে এবং ডাক্তারদের কোনো রকম অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা না দেয়, তাহলে ওষুধের দাম অবশ্যই কমে আসতে পারে।
কেকে/এআর