দেশের
অন্যতম কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার
শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ অনিবার্য
জুলাইয়ে / আমাদের তরুণেরা-যুবকেরা তাদের তারুণ্য এবং সাহস দিয়ে সেটাই যেন
প্রমাণ করে গেলো। যদিও এর শুরু অনেক আগে এবং তা নিয়মমাফিক ধীরে ধীরে
এগুচ্ছিলো কিন্তু সরকারের দমননীতি হঠাৎ করেই তাতে ঘি ঢেলে দিল।
রংপুরের
আবু সাঈদ হত্যায় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ক্রোধে ফেটে পড়ল। তারা দলমত
নির্বিশেষে নেমে এলো রাজপথে। সঙ্গে যুক্ত হলেন জনগণ। তাদের দমাতে তৎপর হয়ে
উঠলো ফ্যাসিস্টদের লাঠিয়াল ছাত্রলীগ। তাদের পাশাপাশি মাঠে নামলো সরকারের
পেটোয়া পুলিশ বাহিনী, বিডিআর আর সেনাবাহিনী। আন্দোলনরতদের ওপর নির্বিচারে
গুলিবর্ষণে শহিদ হতে থাকল একের পর এক ছাত্র ও জনতা। একসময় দুর্বার সেই
আন্দোলনে পালিয়ে গেলেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা।
একাত্তরের
পর এক আন্দোলনে এতো মৃত্যু আর কখনো ঘটেনি। এতো রক্তপাত, হত্যা ও নির্যাতনে
কবিহৃদয় কি চুপ করে থাকতে পারে? অস্থির তারুণ্যের হাত দিয়ে বেরুতে লাগলো
একের পর এক বিদ্রোহ ও বিপ্লবের শানিত গাথা। দ্রোহের এই ধ্বনি যেন আবহমান
বাংলার ধ্বনি। চিরায়ত সেই বিপ্লবগাথা থেকে কয়েকটি আজ তুলে ধরা হলো। আশা করি
পাঠক এর মধ্য দিয়ে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারবেন।
মুগ্ধর জন্য এলিজি
শাহীন রেজা
আমার
সেজোখালা মৃত্যুর আগে পাকা পেঁপে খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওই সময়ে লাকসামে
কর্মরত খালুজান শত চেষ্টাতেও তা জোগাড় করতে পারেননি আর এ সংবাদে মানসিকভাবে
আহত আমার নানি আমৃত্যু পাকা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
‘মুগ্ধ’ আমার রক্তের কেউ নয় অথচ
ইউটিউবে দেখা ওর নিষ্পাপ মুখ আমাকে সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল
টিয়ার শেল আর তীব্র ধোঁয়ার মধ্যে
চোখ মুছতে মুছতে ‘পানি লাগবে পানি লাগবে’ বলে ছুটতে থাকা ছেলেটি
প্রচণ্ড বুলেটে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লে মনে হলো
‘মুগ্ধ’ নয়- লুটিয়ে পড়ল আমার স্বদেশ; বাংলাদেশ-
প্যাকেট থেকে ছড়িয়ে পড়া পানির বোতলগুলো ভিজে উঠলে রক্তে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু নয় যেন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে গেল একঝাঁক তীব্র বুলেট
এরপর আমি আর ঘুমুতে পারি না
আমার রাতজুড়ে শুধু ক্ষোভ শুধু ঘৃণা
পানির গ্লাস হাতে নিলেই তাতে ভেসে ওঠে ‘মুগ্ধ’র মুখ; রক্তের তীব্র ধারা।
দীর্ঘ দীর্ঘতর জুলাই
কামরুজ্জামান
ঘুমাতে পারি না জুলাইর রাতগুলো হিম
হয়ে আসে শরীর হৃৎপিণ্ড অস্থিমজ্জা
অজস্র গুলির শব্দের আঁধার কালো
পঁচিশে মার্চের কথা স্মরণে আসছে যেন।
টিনিট্রন ফ্যাল্ট স্ক্রিনে ছড়িয়ে যাওয়া রক্তস্রোত
এত রক্ত কোনোদিন কেউ দেখেনি এভাবে স্বাধীন স্বদেশে
কত দ্রুত লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর পরিসংখ্যান।
প্রথম সাহসী যুবক আবু সাঈদ রংপুরে
ইতিহাসের মহানায়ক, যাকে খুব কাছ থেকে
গুলি করে হত্যা করা হলো প্রকাশ্য দিবালোকে
নির্মম নির্দয় পৈশাচিকতায় স্তব্ধ হয়ে
আসে বোধ, দরিদ্র কৃষকের সন্তান রক্ত দিয়ে
মর্মমূলে আঘাত করে জাগিয়ে দিয়েছে জাগো-
জাগো লাখো কোটি জনপদে বাংলার তরুণী তরুণ নওজোয়ান...
ঢাকার উত্তরায় পানি লাগবে পানি বলে দীপ্ত স্বরে
ছুটে বেড়াচ্ছিল অসামান্য হৃদয়বান যুবক মুগ্ধ
গুলি টিয়ারশেল উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিল সে
মাথায় গুলি করে হত্যা করা হলো তাকে আচানক
সাতানব্বইটি হেলিকপ্টার উড়ালো আকাশে
জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় নির্বিচারে গুলি
সাউন্ড গ্রেনেডে নয়ামাটি মহল্লায় উন্মুক্ত ছাদে
পিতার কোলে মাথায় বুলেটবিদ্ধ হলো শিশু রিয়া মনি...
নিপুণ লক্ষ্যভেদ স্নাইপার লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে
গুলি করে করে নিভিয়ে দিচ্ছে শত শত জীবন প্রদীপ।
দীর্ঘ দীর্ঘতর আরও দীর্ঘ হয়ে উঠলো জুলাই
রক্তে রক্তে গাঢ় প্রগাঢ় হলো দেখি যেন
পতাকার লাল সূর্য সহস্র সহস্র শহিদের খুনে খুনে
প্রলম্বিত হয়ে চলেছে জুলাই রক্তের বন্যায়
মর্গগুলো উপচে পড়েছে লাশে লাশে নামছে রক্তস্রোত
একত্রিশে জুলাই বত্রিশে জুলাই তেত্রিশে জুলাই
চৌত্রিশে জুলাই পঁয়ত্রিশে জুলাই ছত্রিশে জুলাই...
রক্তের স্রোত থামেনি এখনও প্রতিদিন শুনি
মৃত্যুর সংবাদ গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু আছে যারা নিবিড় পর্যবেক্ষণে
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে।
ক্ষমা করো
তমিজ উদ্দীন লোদী
কী যে হয়েছে এখন
কবিতা লিখতে গেলেই উঁকি দেন মাহমুদ দারবিশ
আঙুল উঁচিয়ে ধরেন মায়াকোভস্কি, নেরুদা
রক্তাক্ত ব্যান্ডেজমাখা লোরকার চোখ জ্বলে ওঠে
তারা যেন সমস্বরে বলে, এতো এতো অসঙ্গতি, এতো এতো তোলপাড়
তোমার কবিতা কই?
মনে মনে বলি আছে তো, কিন্তু আপনাদের মতো জ্বলে উঠতে পারলাম কই?
হত্যায়, গুম-এ, গুলিতে, বিচারবহির্ভূত নিধনে ভেসে গেছে আমার বদ্বীপ
একের পর এক ভোটাধিকার প্রয়োগবিহীন নির্বাচন তামাশায়
জেঁকে বসেছে স্বৈরাচার।
লুটেরার মচ্ছবে, তাণ্ডবে ফোকলা হয়ে গেছে টাঁকশাল
হাজারো, লাখো কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তস্করেরা
ফ্যাসিজম আর নাৎসিজমের পথ ধরে তৈরি হয়েছে নারকীয় আয়নাঘর
রোদনে, চিৎকারে, আহাজারিতে মথিত হয়েছে বাতাস
তৈরি হয়েছে একাধিক স্যাডিস্ট, পিশাচ
না, আমাদের কলমে সেরকম কোনো ঝঙ্কার ওঠেনি।
তুমি ও বাংলাদেশ
ফরিদ ভূঁইয়া
একবিংশ শতাব্দীর চব্বিশের কে সে তুমি?
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন দানব পোষে, তার নিষ্ঠুর গুলির মুখে
ত্যাগের সুন্দর উদযাপনে দেখেছ নিরস্ত্র দু’হাতে
সত্যের সাহসী বুকে-জাগ্রত নতুন বাংলাদেশ!
বিংশ শতাব্দীর পরিক্রমা-
ভাষার বায়ান্ন
উর্দি ছেঁড়ার ঊনসত্তর
স্বাধীনতা সংগ্রামের একাত্তর
তারপর, আবারও উর্দি ছেঁড়ার নব্বই
প্রতিবারে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর অধিকার প্রতিষ্ঠায়
জীবন বাজির বীরের লড়াই-
আবু সাঈদের বুক সে বিশ্বাসে নতুন শোভায়;
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেখেছ সবাই
পরপর গুলিবিদ্ধ, তবু সে সটান-সাহসে সুঠাম বাংলাদেশ!
শোষিত বঞ্চিত মানুষের হয়ে
দুর্ভেদ্য জঞ্জালে চাপা পড়া সময়ের
পাষাণের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে
তোমার জীবন দিয়ে অপার সাজালে-ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ
স্বপ্নহারা বাংলার আকাশে অন্ধকারে
চিরচিহ্ন তারা তুমি-জ্বলজ্বলে দিশা;
নির্ভয় চিত্তের এক জীবন।