প্রকাশ: শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০২৪, ১১:৩৩ এএম (ভিজিটর : ৬৭)
বিষয়টি আগে কখনো এত সিরিয়াসলি দেখেননি সুলতান সাহেব। কিরণ সাহেবের দোকান থেকে সওদাপাতি খুব প্রয়োজন না হলে তেমন একটা করেন না। পারতপক্ষে দোকানটা এড়িয়ে যান। ব্যক্তি কিরণ সাহেবকেও মোটামুটি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রেও খুব প্রয়োজন না হলে সেখানে যান না তিনি। মাঝে মাঝে এখানে গল্প করতে আসলে অল্প কথায় সারার চেষ্টা করেন।
কিরণ সাহেব বাড়িওয়ালা মানুষ। বাড়ির নিচেই দোকান। নিজের বাড়ি ভাড়া তো লাগেই না দোকানেরও কোনো ভাড়া নাই। ফলে অন্যদের সাথে তুলনা করে দোকান হিসাব করলে পুরা ভাড়ার টাকাটাই তার লাভ।
এই দোকানে এখন অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আগে শুধু ফার্মেসি ছিল, কিছু ওষুধ পাওয়া যেত, সব না। কিরন সাহেব দোকানে বসে সময় কাটতেন। ভাড়া দিতে হয় না। ঝামেলা নাই। অনেকদিন এভাবে চলেছে। পরে ফার্মেসির দিকে মনোযোগ দেন। ওষুধের বেচাকেনা বাড়তে থাকলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন দোকান আরো বড় করবেন। মুদি আইটেম উঠাবেন। আর প্রয়োজনীয় সব ওষুধই রাখবেন।
সেই দোকান এখন জায়গা হিসেবে মোটামুটি বড়ই বলা যায়। ঘরটাকে ভেঙে ভিতরদিকটা আরো নিয়েছেন দোকানের জন্য। দোকানের আইটেম বাড়তে থাকে। নানাধরনে প্রসাধনী যোগ করেন। একদিন এসব পণ্যে সাথে একটা লম্বা ও একটা খাটো চ্যাপ্টা ফ্রিজ আসে। মানে তিনি ড্রিংস আইটেম যোগ করেছেন। দই আইসক্রিমও রাখবেন। এখন এটা মুদি কাম ফার্মেসি। ছোটখাট একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এ পাড়ায় এটাই এখন সবচেয়ে ভালো দোকান।
নিজেরই যেহেতু জায়গা দোকানে জায়গাটাও ঠেলেঠুলে গ্যারেজ পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছেন। এতে কিছু মোটরসাইকেল বিতাড়িত হয়। বর্ধিত জায়গা মাথায় রেখে এ পর্যায় কিরণ সাহেব তেল চিনি ডিম উঠান। এখন দোকানে প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রায় সবই পাওয়া যায়। কাস্টমার আসে যায়। টুকটাক ভালোই বেচাকেনা হয়। সুলতান সাহেবও যান। জরুরি প্রয়োজনে দুই একটা ওষুধ কেনেন। মূলত ওষুধের জন্যই যান। ফাঁকে ফোঁকে একটা দুইটা মুদি জিনিস কেনেন। তবে সেটা বেশি না।
ইদানিং একটা বিষয় সুলতান সাহেবের মনে খটকা লাগে। তিনি খেয়াল করেছেন, কেউ ভাংতি ২ টাকা পেলে ভাংতি হিসাবে একটা দুই টাকার চকলেট ধরিয়ে দেন কিরণ সাহেব বা তার দোকানের ছেলেটি। দুই টাকার নোট বা কয়েন না থাকলে তার জায়গায় একটা সিভিটের পাতা থেকে কেচি দিয়ে সুন্দর করে কেটে একটা সিভিট ধরিয়ে দেন। এই কাম কিরণ সাহেব নিজে করেন। ছেলেটি করে। কিরন সাহেবে যাতে ভুল না করে সেজন্য আগবাড়িয়ে তার কর্মচারি ছেলেটিও তাকে মনে করিয়ে দেয়। বিল হলো ২৮ টাকা, কেউ দিল ৩০ টাকা। সে বলে দেবে, ২৮ টাকা হইছে, একটা সিভিট দিয়ে দেন।
ঘটনাটা সুলতান সাহেবের সাথেও হয়েছে। একবার না বেশ কয়েকবার। হয় তাকে দুই টাকার জায়গায় চকলেট নিতে হয়েছে না হয় সিভিট। চকলেট সিস্টেম চালু হওয়ার পর থেকে তা দ্রুত সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। এটা এখন অনেকেই করে থাকে। তিনি ভাবেন, খুচরা না রাখার ফন্দি। এটা অনেকেই করে। আমার তো চকলেট লাগবে না কেন দেবে? ওরা ইচ্ছা করেই এটা করে। চকলেট বেচার বদলে এভাবে দিলে কাজও হলো চকলেটও বেচা হলো। চকলেটের লাভটা এমনই এসে যায়। এই দোকান আবার একধাপ এগিয়ে সিভিট সিস্টেম চালু করেছে।
কি আর করা, একদিন দুই দিন তিনি কিছু বলেননি। এই চকলেট বা সিভিট কেন? সে কি ইচ্ছাকৃত? এগুলো কে খাবে? কিন্তু তারা তো দিয়েই যাচ্ছে। এটা তার মাথায় খোঁচা দিতে থাকে। তার মনটা খচখচ করতে থাকে। কিছু বলেন না।
এর মধ্যে ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। আগের চিন্তার সাথে মিলিয়ে এবার হতাশ হন ওদের কর্মকাণ্ড দেখে। সেদিন বারো টাকা পিসের দুটো ওষুধের জন্য খুচরা নেই বলে তারা পঁচিশ টাকা রেখে দেয়। তিনি ফেরত পান পঁচাত্তর টাকা। এতে তিনি মানসিকভাবে অপ্রস্তুত হয়ে যান। তিনি ভাবেন দোকানদার হিসেবে এক টাকা কম রাখতে পারত। তাতেও তার লাভ থাকে। অন্য দোকানদারা হলে তাই করত। কিন্তু সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের বাহিরে গিয়ে তিনি অতিরিক্ত আরো এক টাকা রেখে দেন খুচরার অজুহাতে। তিনি কর্মচারির দিকে চেয়ে থাকেন। শুধু বলেছিলেন, বারো টাকা করে দুটোর দাম পঁচিশ টাকা! বিব্রত হন এবং মনে মনে খুব রাগ হন। পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন কিরন সাহেব। তিনি চুপচাপ ছিলেন। সুলতান সাহেব কাউকে কিছু বলেননি। বিষয়টি তিনি হজম করেন।
কিরন সাহেবের কাছে পুরা বিষয়টি প্যাঁচগোছের লাগে। তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। তিনি পকেটে হাত দিয়ে দেখেন সকালের দেয়া সিভিট এখনো আছে। এর আগের কখনো চকলেট কখনো সিভিট যা পেয়েছেন সেগুলোতে তেমন আমল দেননি। কিন্তু বাড়তি রাখার বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সাথে নেন। এর একটা বিহীত করে সেই দোকানকে বিদায় জানাবেন বলেও ঠিক করেন।
সুলতান সাহেব এখন ঘনঘন কিরন সাহেবের দোকানে যান। ওষুধ না লাগলে মুদি আইটেমের এটা ওটা কেনেন। কখনো চকলেট, কখনো সিভিট খুচরা টাকার বদলে পান। কিছু না বলে নিয়ে নেন। এগুলো বাসার কাউকে আগে দিলেও এখন নিজের পকেটে রেখে দেন। জমাচ্ছেন। এভাবে বেশ কয়েকটা চকলেট আর সিভিট তার পকেটে জমা হয়েছে।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। সুলতান সাহেব ফুরফুরে মেজাজে কিরন সাহেবের দোকানে যান। এটা ওটা কিনে তার বিল হলো ৩৭৫ টাকা। নডুলস কিনলেন এক প্যাকেট ১৬৫ টকায়, আলু এক কেজি ৬০ টাকা আর ডিম ১৫০ টকার। এগুলো বাসায় কাজে লাগবে সেই হিসেবেই কেনা। যদিও এসব জিনিস আপাতত প্রয়োজন ছিল না।
এবার প্যান্টের ডান পকেট থেকে বের করে আনলেন একমুঠ চকলেট। কিরন সাহেবের চোখ গেল চকলেটের দিকে। তাকিয়ে থাকলেন হা করে। তার মুখে খুশির কিরন নেই। তিনি বুঝতে পারছেন না সুলতান সাহেব কি করছেন। দোকানের ছেলেটাও ততক্ষণে অবাক হয়ে দেখছেন সুলতান সাহেবকে। সুলতান সাহেব চকলেট গুনলেন দশটা। মোট চকলেট থেকে দুটো আবার পকেটে রেখে কিরন সাহেবকে বললেন, নেন।
কিরন সাহেব কিছু বলতে পারছে না, দেখছেন। আর মনে মনে ভাবছেন, হচ্ছেটা কি!
সুলতান সাহেব গুনে গুনে আটটা চকলেট দিলেন। বললেন, এই নিন আট দুগুনে ষোলো টাকা। আর মানিব্যাগ বের করে গুনে গুনে দিলেন ৩৬০ টাকা। বললেন, এই হলো মোট ৩৭৬ টাকা। আরো বললেন, একটাকা ফেরত দেওয়া লাগবে না।
দোকানের ছেলেটা বলল, কি দেন এসব! সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না।
তিনি আরো মজা করে বললেন, রেখে দেন কাজে লাগবে। একটা চকলেট মানে তো ২ টাকা। ঠিক আছে না? আপনারাই তো দিয়েছেন। এগুলো সব আপনার দোকান থেকে পেয়েছি। ভাংতি টাকা ফেরত না দিয়ে এগুলো দিয়েছেন। পাবো দুই টাকা, দিয়েছেন চকলেট ধরিয়ে। সেগুলো যতœ করে রেখেছি। আগে যেমন চকলেট দিয়ে ভাংতি শোধ হয়েছে, তখন আপনারা দিয়েছেন এবার আমি দিলাম, মানে কেনাকাটার বিল দিলাম। খুচরা টাকাগুলো দিলাম চকলেটে! এগুলো প্রত্যেকটাই তো দুই টাকা। অসুবিধা আছে কোনো! একটু খোঁচা দিয়ে বললেন।
না, মানে মানে। কিরন সাহেব আমতা আমতা করেন। অতি চটপটে ছেলেটি দ্রুত বুঝে যায় ব্যাপারটি। সে কটমট করে তাকায়।
আমি কি কোনো ভুল করেছি। বিল কি কম দিলাম। ঠিক আছে না?” সুলতান সাহেব গলাটা স্বাভাবিক রেখেই বলেন। দুজনের দিকেই ঘুরেঘুরে তাকান।
কি করেন? ছেলেটা এবার আর রাগ সামলাতে পারে না। কিরন সাহেব চালাক মানুষ। সুলতান সাহেব ও ছেলেটার, দুজনের ভাবসাবই বুঝতে পারেন।
তারা কিছু বলার আগেই সুলতান সাহেব বললেন, সিভিটও আছে। সাথে আনতে ভুলে গিয়েছি। আপনারা দিয়েছেন দুই টাকার জায়গায়। একসময় পাবেন। টাকা হিসেবে ব্যবহারের জন্য এখন থেকে সাথে রাখব।
ছেলেটা এবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিরন সাহেব বাধা দিলেন। বিমর্ষ মনে ছেলেটার হাতটা টেনে ধরে তাকিয়ে থাকলেন সুলতান সাহেবের চলে যাওয়ার দিকে।