আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল্লাহ। তিনি ড্রাগন ফলসহ বিভিন্ন সবজি চাষের পাশাপাশি এবার পরীক্ষামূলকভাবে বস্তায় রসুন চাষ করে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তার এই অভিনব চাষ পদ্ধতি স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে।
আব্দুল্লাহ ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কৃষি সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ থেকেই তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতেন। কিছুদিন আগে তিনি ফরিদপুরের একটি নেট ঝাল কোম্পানিতে চাকরি করলেও চাকরি ছেড়ে এলাকায় ফিরে আসেন এবং ছোট ভাই আবু তালেবের ড্রাগন বাগানের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। পাঁচ বছর ধরে ড্রাগন চাষ করে সফল হওয়ার পর তিনি ড্রাগনের ফাঁকা জায়গাগুলোতে বস্তায় সবজি চাষ শুরু করেন।
প্রথমে তিনি বেগুন, করলা, শসা, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেন এবং এতে ভালো ফলাফল পান। এরপর বাজারে মসলার চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি পরীক্ষামূলকভাবে রসুন চাষের উদ্যোগ নেন।
কোনো পরামর্শ বা সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই তিনি ২,৫০০ পলিথিনের বস্তায় রসুন চাষের উদ্যোগ নেন। গবাদিপশুর প্রসাব, গোবর, গুড় ও বেসন মিশিয়ে তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে জৈব সার তৈরি করেন এবং তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বস্তায় ভরেন। এরপর রসুনের কোয়া রোপণ করেন এবং কয়েকদিন পরপর সেচ দেন।
বর্তমানে তার রসুনের গাছগুলো সতেজ ও সবল রয়েছে। প্রতি বস্তায় ২০-২৫টি গাছ রয়েছে, যা থেকে প্রত্যাশিত ফলন ৫০০-৬০০ গ্রাম রসুন।
আব্দুল্লাহর হিসাবে, প্রতিটি বস্তায় গড় খরচ হয়েছে ১৫-২০ টাকা, যার ফলে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। চৈত্র মাসে উত্তোলনের পর বাজার দর ভালো থাকলে তিনি প্রতি বস্তা ২০০ টাকা দরে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
তার মতে, বস্তায় চাষ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এতে খরচ কম হয়, রোগ-বালাই কম থাকে এবং কম পরিশ্রমেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। এটি অত্যন্ত লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি।
আব্দুল্লাহ জানান, এখন পর্যন্ত কৃষি বিভাগ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। তবে যদি সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে তিনি বৃহৎ পরিসরে বস্তায় রসুন চাষের পরিকল্পনা করেছেন। তিনি মনে করেন, এটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে দেশের রসুন উৎপাদনে বিপ্লব ঘটবে এবং বিদেশ থেকে রসুন আমদানির পরিমাণ কমে আসবে।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ওমর ফারুক বলেন, রসুন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী মসলা ফসল। এটি রান্নার স্বাদ ও গন্ধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ঔষধি গুণও বহন করে। প্রতি বছর বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ রসুন আমদানি করা হয়, যা দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর। আব্দুল্লাহর এই উদ্যোগ সফল হলে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
তিনি আরো বলেন, বস্তায় ফসল চাষ করলে খরচ কম হয়, রোগ-বালাই কম হয়, সেচ ও সার কম লাগে এবং পরিশ্রমও তুলনামূলকভাবে কম হয়। তবে আবাদযোগ্য জমিতে বস্তায় চাষ উপযুক্ত নয়, বরং অনাবাদি জায়গাগুলোতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। তামাকের পরিবর্তে রসুন চাষ করলে কৃষকরা দ্বিগুণ লাভবান হতে পারেন। যদি আব্দুল্লাহ কৃষি বিভাগের সহযোগিতা চান, তাহলে তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হবে।
এলাকাবাসীরা জানান, আব্দুল্লাহর বস্তায় চাষ পদ্ধতি দেখে তারা বিস্মিত এবং অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অনেকেই তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে নিজেদের জমিতেও এ ধরনের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করতে আগ্রহী। তার কৃষি উদ্যোগ স্থানীয় শ্রমিকদের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে, যা এলাকায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তার এই অভিনব উদ্যোগ দেখতে প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা এবং এনজিও কর্মীরা আসছেন।
রসুন শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ায় না, এটি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধেও কার্যকর। নিয়মিত রসুন খেলে রক্তচাপ ও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
রসুন চাষের জন্য দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে রসুনের চাষ শুরু করা হয়। বস্তায় চাষ করলে পানি জমে থাকার ঝামেলা থাকে না, ফলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আব্দুল্লাহর মতো উদ্যোগী কৃষকরা যদি সরকারি সহযোগিতা পান, তাহলে বাংলাদেশে আধুনিক কৃষির নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। বস্তায় ফসল চাষ একটি ব্যতিক্রমী ও লাভজনক কৃষি পদ্ধতি, যা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। আব্দুল্লাহর এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়লে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
কেকে/এএম