অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণে অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। বছরের মাঝপথে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়ে ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্য যেসব সমস্যা আছে সেখানেও খুব একটা সফলতা নেই। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অর্থনীতি।
ব্যবসা-বাণিজ্যে ভ্যাট বৈষম্য রয়েছে। ট্যাক্সের বোঝার কারণে সুপারশপে ক্রেতা ও বিক্রি কমেছে। পরিবহনের চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি। এটা বন্ধ না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে না, কারণ পণ্যের দাম বাড়তি থাকবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, জীবনযাত্রার মান বাড়বে না। ব্যবসা-বাণিজ্য এগোবে না। দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) কনফারেন্স হলে আয়োজিত ‘ভোক্তার কাঁধে বাড়তি করের বোঝা : উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে কিন্তু এ সময় অর্থনীতিতে সফলতা নেই বললেই চলে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি অথবা প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণে অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। অন্য যেসব সমস্যা আছে সেখানেও খুব একটা সফলতা নেই। ফলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমান সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক নীতিগুলোর একটা সাধারণ ধরন রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি এককভাবে কোনো ফলাফল আনতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উঠিয়ে রেখেছে। এটি মূল্যস্ফীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এটি ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, অর্থনীতিতে যেসব নীতি নেওয়া হচ্ছে সেগুলো একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পৃক্ততা নেই। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রক্রিয়াগুলো সঠিক করতে হবে। সরকারের রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই অর্থনীতির গতি বাড়াতে হবে। অর্থনীতি স্থবির করে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে আমরা সক্ষম হব না।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, বর্তমান সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল দ্রব্যমূল্য কমানো। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও যখন সেটি করা গেল না তখন শুল্ক কমানো হলো। তবে নিত্যপণ্যের দাম তো কমলই না, উল্টো সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হলো। তখন আইএমএফ বলল রাজস্ব ঘাটতি থাকলে চতুর্থ কিস্তি তারা দেবে না। এ পরিস্থিতিতে সরকার কিছু পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে দিল। এসব পণ্যের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বছরে কোটি টাকা আয় করেন এমন ৬৭ শতাংশ মানুষ করজালের বাইরে। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের আয় কোটি টাকার বেশি হলেও তারা করজালে নেই। এমন ফাঁপা করজাল বা ক্ষুদ্র করজাল দিয়ে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো যাবে না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়ে সরকার দুর্নাম নিল। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকারের অন্য কোনো বিকল্প ছিল কি না তা দেখতে হবে। কারণ, শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানোয় ১১ হাজার বা সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব পাওয়া যাবে বলা হয়েছে। এতে রাজস্বের ঘাটতি তেমন একটা পূরণ হবে না।
বিকেএমই সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গণমাধ্যম থেকে শুনেছিলাম প্রতি রাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেড় কোটি টাকা চাঁদা পেতেন। এখন তো পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজির কি পরিবর্তন হয়েছে? এখনো যাত্রাবাড়ীসহ অন্য বাজারে চাঁদাবাজি হচ্ছে, কারা করছে, এটা বন্ধ করতে হবে। এটা বন্ধ না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে না, কারণ পণ্যের দাম বাড়তি থাকবে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, রফতানিমুখী শিল্পের জন্য জিরো ভ্যাট বলা হলেও নানা অজুহাতে ভ্যাট বসানো হয়। হঠাৎ এক ব্যবসায়ীর ১১ কোটি টাকার ভ্যাট রেডি করছে কোনো সই ছাড়াই। পরে সেটার নেগুসিয়েশনের জন্য বলা হয়, পরে হয়তো সেটা দু-তিন কোটিতে দাঁড়ায়। রফতানির স্বার্থে, দেশের ভ্যাটের নামে হয়রানি চান না ব্যবসায়ীরা।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে কর না বাড়িয়ে যেভাবে চলছে চলতে দিন। কনসালটেশন শুরু করুন। আমরা এনবিআরের সঙ্গে আরো বেশি আলোচনা করতে চাই। কীভাবে করজাল বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করব।
তিনি বলেন, কেবল ‘কমপ্লায়েন্ট’ বা আইন মানা প্রতিষ্ঠানের ওপর যদি করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আগামী দিনে ভালো প্রতিষ্ঠান টিকবে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না, জীবনযাত্রার মান বাড়বে না। ব্যবসা-বাণিজ্য এগোবে না। বছরের মাঝে এসে পণ্যের ওপর কর, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর মূসক ও শুল্ক বাড়িয়ে দিলে দেশের অপকার ছাড়া কোনো উপকার করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে ভ্যাট বৈষম্য রয়েছে। পাশাপাশি দুই দোকানের মধ্যে আকাশ-পাতাল ভ্যাটের বৈষম্য। সুপারশপে বাড়তি ভ্যাট, কাছেই অন্য দোকানে ভ্যাট নেই। এতে সুপারশপে বিক্রি কমেছে, স্বাচ্ছন্দ্যে আসতে পারছেন না ক্রেতা।
তিনি বলেন, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। যারা বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশনে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করেন, সরকারের বাইরে থেকে তখন সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, যেই সরকারে যান তখন আর জনগণকে ভালো লাগে না। জুলাই-আগস্ট পরবর্তীসময়ে সরকার গঠনের পরই হঠাৎ করে ভ্যাট বাড়ানো হলো। ব্যবসায়ীরা আশাই করেনি। এটার জন্য এখন যৌক্তিক সময় নয়।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, কর বৃদ্ধির কারণে ভোক্তাকেও বেশি দামে খাবার কিনতে হবে। কৃষকের মতো সাধারণ মানুষও ভুগবে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকারকে এটা চিন্তা করতে হবে। বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার না হলে প্রক্রিয়াজাত কৃষি খাত খুব বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১৬ শতাংশ ব্যাংকের সুদহার, দিনে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, গ্যাস থাকে না। কীভাবে টিকে থাকবো সে লড়াইয়ে অনেকে ব্যস্ত। বাড়িঘর বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়ে আমরা ব্যবসা করছি, তারপরও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হই, সেটা কাম্য নয়।
কেকে/এআর