দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক মিত্র হলেও গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত একাধিক ইস্যুতে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দল দুটি। রাষ্ট্র সংস্কার থেকে শুরু করে নির্বাচনের সময় পর্যন্ত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা গেছে দল দুটির শীর্ষ নেতাদের।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত দুটি কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুপারিশ দিয়েছে। যে কারণে এ নিয়ে বিতর্কের পাল্লা আরো ভারী হয়েছে। এ অবস্থায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আগামী দিনগুলোয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ আরো বাড়বে।
দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় বিএনপি ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবি জানালে তার বিপরীত অবস্থান নেয় জামায়াতে ইসলামী। দলটি বলে- ‘আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন’। এরপর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ থেকে শুরু নানা ইস্যু নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করে দুই দলের নেতারা। এরপর সামনে আসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি আসলে সেটাকে সমর্থন করে জামায়াত। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থান নেয় বিএনপি। দলটি বলে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আগে দেশে একটি নির্বাচিত সরকার গঠন হবে, তারপর সেই সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করবে।
গতকাল এক যুগ পর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে ‘জরুরি সংস্কার’ সেরে তারপর ভোট, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের দাবি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ‘নো ইলেকশন উইদাউট রিফর্মস’।
তবে এক্ষেত্রে সব সংস্কার সুপারিশ নয়, নির্বাচনসংক্রান্ত যেসব সুপারিশ ‘অতি জরুরি’ সেগুলো আগে সারতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অন্তত নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান ও অর্গানগুলো জড়িত, সেগুলোর সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে।’ নির্বাচনকে ‘নিরপেক্ষ’ করতে যে সময়টুকু প্রয়োজন, সেটা নিয়ে নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান রেখে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘জনগণ চায় স্থানীয় সরকার সচল হোক, আমরাও চাই জাতীয় নির্বাচনের আগে হোক স্থানীয় নির্বাচন।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সেই সময় দিতে জামায়াত প্রস্তুত। আমরা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে বলেছি। বাংলাদেশের জন্য এটি প্রয়োজন, সংসদ কার্যকরের জন্য প্রয়োজন। প্রবাসী ভোটারদেরও ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।’ সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিএনপির যে আপত্তি, সে বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘জনগণের আকাক্সক্ষা স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক।’
ডিসেম্বর ধরে ভোটের প্রস্তুতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গোলাম পারওয়ার বলেন, ‘আমরা বলেছি, সরকার একটি টেনটেটিভ আইডিয়া দিয়েছে। তারা যদি তাদের ঘোষিত সময়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ শেষ করে নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার করতে পারেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। মাস আমাদের কাছে ফ্যাক্টর নয়। সংস্কারটা পূর্ণ করে নির্বাচন ফেয়ার হবে কিনা, সেটা জন্য যত মাস লাগে আমরা প্রস্তুত আছি।’
একইদিন দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে, বাংলাদেশের মানুষ স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আসবে। নির্বাচনটা হওয়া দ্রুত দরকার প্রধানত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা, অন্যটি সুশাসন চালু করা।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমরা চাই না। যদি হয় তাহলে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশটাকে আরো ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাবে। যত দ্রুত নির্বাচন হবে, তত দ্রুত দেশের পরিস্থিতি সহজ হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আয়নাঘরের পরিদর্শন বিষয়ে করা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমি এই বিষয়টাকে ভিন্নভাবে দেখি। গুম করা, হত্যা করা এটাতে কোনো দলের কথা আমি বলতে চাই না। এখানে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে গুম করা হয়েছে। এ কথাগুলো আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি। যখন আলজাজিরায় প্রথম রিপোর্ট করা হয়, তখনো সরকার সম্পূর্ণভাবে এটিকে ডিনাই করেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই এইভাবে চলে আসছে।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা স্বস্তি প্রকাশ করছি যে, সত্য ঘটনাই উদ্ঘাটন হয়েছে। সমস্যা হচ্ছেÑ জাতিসংঘ যখন বলে তখন আমরা বিশ্বাস করি; যখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলো বলি, অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। আমরা ধন্যবাদ জানাব যে, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ কমিটি এসেছেন, তারা রিপোর্টটা সঠিকভাবে করেছেন। সেজন্য ধন্যবাদ জানাই।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশেই এসব ঘটনা হয়েছে। যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার নির্দেশেই হয়েছে। যত মানবাধিকার লঙ্ঘন, তার নির্দেশেই হয়েছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া, ইনস্টিটিউশনগুলো ধ্বংস করে দেওয়া; এসব তার নির্দেশেই হয়েছে। এক কথায় সেগুলো রিপোর্টে উঠে এসেছে। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, হাসিনা একজন ফ্যাসিস্ট, তিনি গণহত্যা করেছেন, মানুষের ওপর নির্যাতন করেছেন।’
এর আগে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দলের এক কর্মশালায় সরকারকে সতর্ক করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন হবে না। আমরা ১৭ বছর আন্দোলন করেছি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার দাবিতে। অন্য কোনো নির্বাচনের জন্য নয়।’ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগ মাথা বের করে হাজির হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। ‘নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র না থাকলে, আমরা আশা করি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি উঠে আসে। এ বিষয়ে সব দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মতামত দেওয়া হচ্ছে, কারণ স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা আরো বাড়বে।
গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, এতে অংশগ্রহণকারীদের ৬৫ শতাংশই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনুরোধে, নির্বাচনি সংস্কারগুলোর বিষয়ে এ জাতীয় জনমত জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস।
কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষের মনোভাব বুঝতেই এ জরিপ পরিচালিত হয়। বর্তমানে আমাদের কোনো ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকারের কর্তৃপক্ষ নেই, যে কারণে জনগণ জরুরি বিভিন্ন সেবাবঞ্চিত হচ্ছে।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ কতোটা হবে- এ নিয়েও বড় দুই দলের মধ্যে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। ‘ন্যূনতম সংস্কার’ করেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছে বিএনপি, অন্যদিকে জামায়াত চাইছে নির্বাচনের আগে আরো সংস্কার।
এই অবস্থায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। ছয় সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলো বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে, এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপের সুপারিশ করবে এই কমিশন।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে, আগামী ছয় মাস কমিশনের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে, জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন- রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রমসহ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য পদক্ষেপের সুপারিশ করবে।
কেকে/এজে