জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে জাতীয় সনদের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সেই সনদের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী নির্বাচন ও গণতন্ত্রের দিকে বাংলাদেশের অভিযাত্রা শুরু হবে বলে আলোচনায় উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এ বৈঠক শুরু হয়। ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ২৬টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ জন নেতা অংশ নিয়েছেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো।
ড. ইউনূস বলেন, প্রতিজ্ঞা করি আমরা যেন গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না জানাই। যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল সেটা যেন পরবর্তী সব প্রজন্ম মনে রাখে, তাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে, তাদের আত্মত্যাগ সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে সব রকম চেষ্টা করব, সে স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন করতে পারি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করলাম। প্রথম পর্ব ছিল প্রস্তুতি পর্ব। সে প্রস্তুতি পর্বের অনেক কিছু আপনাদের জানা। তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল প্রস্তুতি, যে স্বপ্নের পেছনে ছাত্র-জনতা আত্মত্যাগ করেছে সেটা সার্থক করতে আমরা যেন এমন একটা দেশ গড়তে পারি যেটা সুশৃঙ্খলভাবে চলবে। যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল সে কাঠামো থেকে যেন আমরা অন্যরূপে বেরিয়ে চলতে পারি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, নতুন বাংলাদেশের পথরেখা (রোডম্যাপ) তৈরির জন্য জাতি আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। এ কাজে ব্যর্থ হলে জাতি আমাদের ক্ষমা করবে না। দীর্ঘদিন সংগ্রাম ও অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা এখানে এসেছি। ছয়টি কমিশনের প্রস্তাবে সেই পথরেখার কথা উল্লেখ আছে। এখন আমাদের কাজ সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি এবং বাস্তবায়নের পথ-পদ্ধতি তৈরি করা। শুরু না করলে সেই প্রক্রিয়া অগ্রসর হবে না। কিন্তু এ প্রক্রিয়া অগ্রসরে সবার ঐকমত্য জরুরি।
বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা আশা করি, দ্রুত সংস্কারের ঐকমত্য তৈরি হবে। অতি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আহ্বান জানিয়েছেন, সংস্কারের যে রিপোর্টগুলো প্রত্যেকটি কমিশন দিল, সেগুলোর ওপর আলাপ-আলোচনা হবে। দলগুলো এটা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে কথা বলবে। একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেজন্য প্রাথমিক আলোচনা সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী ইতিবাচক সব সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাবে বলে জানিয়েছেন দলের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, কমিশন আমাদের কিছু বই সরবরাহ করবে, যা পর্যালোচনার পর জামায়াতে ইসলামী ও সরকারের প্রতিনিধি দলের মধ্যে আলাদা বৈঠক হবে। সেখানে আমাদের মূল সিদ্ধান্ত ও মতামত তুলে ধরব।
আমরা মনে করি, প্রয়োজনীয় সংস্কারে ঐকমত্যে পৌঁছানো উচিত এবং যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় জাতীয় নাগরিক কমিটি :
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আজকে সব দলের অংশগ্রহণে ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠক হয়েছে। ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে দেশের ৫৩ বছরের অসমাপ্ত কাজগুলো সংস্কার কমিশনগুলোর ইফেক্টিভিটির মধ্যদিয়ে সমাপ্ত করতে হবে। অনেক দলই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। আমরাও মনে করি, লোকাল গভর্নমেন্ট ফাংশনাল করতে হবে। আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য একটি নির্বাচনের প্রয়োজন।
এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন চায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি :
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বৈঠকে আমাদের দিক থেকে সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা উল্লেখ করেছি। একটি হচ্ছে (জুলাই-আগস্টের) গণহত্যার বিচার করা, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করা এবং এ বছরের মধ্যে দিয়ে জাতীয় নির্বাচন করে দেশকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার দিকে নিয়ে যাওয়া।
সাইফুল হক বলেন, আমাদের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান শুরুতেই কমিশনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যেখানে আমরা সবাই একমত হতে পারি, তার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। প্রফেসর আলী রীয়াজ পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন যে, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই আমরা একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে চাই। যে সনদ নিয়ে আমরা পরবর্তী নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার দিকে হাঁটতে পারব।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চাই না : পার্থ
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চান না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে তিনি এ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আগামী ৬ মাস কীভাবে সবাই একসঙ্গে কাজ করব, যে কমিশনগুলোর কাজ হয়েছে, তারা কীভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, আমাদের কী কী প্রস্তাব আছে সেগুলোর বিস্তর আলোচনা করব, এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা কথা বলেছেন।
জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান বলেন, স্থানীয় নির্বাচন দিলে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে মারামারির একটা সম্ভাবনা আছে। কোনো সংস্কার যাতে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত না করে। আবার অনেক রাজনৈতিক দল বলেছে যে, স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে ভালো হবে। আমরা পাশে ছিলাম এবং সামনে পাশে থাকব।
সংস্কারগুলো কিছু মূলভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে হওয়া উচিত : মামুনুল হক
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে দলগুলো তাদের মতামত দিয়েছে। তবে আজকে যেহেতু এ বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলক কোনো আলোচনার বৈঠক না, কাজেই এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেকে জাতীয় নির্বাচন আগে চায়, অনেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায়। আমরা এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য বা প্রস্তাবনা দেইনি। আমরা বলেছি, সংস্কারগুলো কিছু মূলভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে হওয়া উচিত।
কর্তৃত্ব ও সংস্কার ছাড়া যে কোনো নির্বাচন হবে বিপজ্জনক : এবি পার্টি
বৈঠক থেকে বেরিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় আছে ঠিকই, কিন্তু কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হয়নি। এ রকম কর্তৃত্বহীন অবস্থায় যে কোনো নির্বাচন হবে বিপজ্জনক। কর্তৃত্ব এবং সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে এ নির্বাচন হতে পারে খারাপ একটা নির্বাচন।
কেকে/এআর