পবিত্র রমজান মাসে বেশি ব্যবহৃত ভোগ্যপণ্যের দরে নিম্নমুখী প্রবণতা চলছে আন্তর্জাতিক বাজারে। অন্যদিকে বেশিরভাগ পণ্য আমদানিতে বড় ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে রমজানের নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। পাইপলাইনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। তবু রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কারসাজির শঙ্কা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের কঠোর নজরদারি।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক থাকলেও স্থানীয় বাজারে কারসাজির কারণে অনেক সময় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি পর্যায়ে নজরদারি দরকার। অতীতে দেখা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। বাজারে দাম বেড়ে যায়। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে রমজান মাস শুরু হবে। ডলারের দাম ঠিক থাকলে রমজানে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে। তারা আরো বলছেন, সরবরাহ নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা নেই। চিন্তার বিষয় হলো মার্কিন ডলারের দাম। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
বিগত ছয় মাসের হিসাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমদানি বেড়েছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) নিত্যপণ্যের চাহিদা, আমদানি ও আমদানির ঋণপত্র খোলা এবং স্থানীয় উৎপাদন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে।
এদিকে আসন্ন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পর্যাপ্ত আমদানি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক পণ্য বাজারে এসেছে আবার অনেক পণ্য পাইপলাইনে রয়েছে। তারপরও দাম ও পণ্য সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা দেখছেন খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলেছে, আসন্ন রমজানসহ অন্যান্য সময়ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণ এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এলসি খোলার হার বেড়েছে প্রায় তিন শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে ৩২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা হয়েছিল ৩১৬ কোটি ডলারের। সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছরে ১০ কোটি ডলারের বেশি এলসি খোলা হয়েছে।
সাধারণত প্রতি বছরই রমজানে ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, ছোলা, খেজুরসহ বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। রমজান ঘিরে দেশের মানুষ ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ে শঙ্কা থাকে। তবে এবার বাজারে কোনো পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি হওয়ার শঙ্কা নাই বলে জানা গেছে। আমদানিকারকরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এখনো পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় চলছে পণ্য খালাসের কাজ। পণ্যবাহী শত শত জাহাজ খালাসের অপেক্ষায় এখনো বন্দরে রয়েছে। পুরো ফেব্রুয়ারিজুড়ে আরো নিত্যপণ্য আমদানি হবে। ফলে সরবরাহ বাড়বে।
এরপরও যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এখনো ভোজ্যতেল সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। রাজধানীর মিরপুরের কাজিপাড়ার মুদি দোকানদার রকিব হোসেন জানান, আমরা এখনো অর্ডার দিয়ে সয়াবিন তেলের বোতল পাচ্ছি না। কোম্পানিগুলো দিচ্ছে না। কবে স্বাভাবিক হবে খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রেতারা তেল কিনতে এসে ঘুরে যাচ্ছে। একই অভিযোগ করলেন আরেক খুচরা ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, প্রতি বছরই কোম্পানিগুলো এমন করে। এবরাও সুযোগ খুঁজছে। দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। তারা দাম বাড়িয়ে দিলে আমাদের কিছু করার থাকে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টন; যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬ কোটি ৫৮ লাখ টন। এ ছাড়া জানুয়ারিতে পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার টন। চিনি আমদানি হয় ১ লাখ ৪ হাজার টন।
পেঁয়াজ আমদানি হয় ৮২ হাজার টন। ডাল আমদানি হয় ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছোলা আমদানি হয়েছে ২৮ হাজার ৩৩৪ টন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১২ হাজার ৬৭৬ টন। খেজুর আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ৯৭৮ টন। এভাবে রমজানের প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হওয়ায় বাজারে সংকট থাকবে না।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, আমদানি করা কয়েক হাজার টন পণ্য নিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সাগরে ভাসছে দুইশর বেশি লাইটার জাহাজ। তবে দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে আমদানিকারকরা খালাস না করে সাগরে ভাসমান গুদাম বানিয়ে পণ্যগুলো রেখেছেন। সময়মতো পণ্য খালাস না করায় চট্টগ্রামে লাইটার জাহাজের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আমদানিকারক বলেন, রমজান মাসে বিভিন্ন পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। এবার এসব পণ্যের চাহিদার বেশি আমদানি করা হয়েছে। চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত আরো আমদানি করা হবে। রমজানে কোনো পণ্যের সংকট হওয়ার কথা না।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতি বছরেই রমজানকে সামনে রেখে কিছু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করে। এবারো ভোজ্যতেলের বাজারে এখনো তা হচ্ছে। এবার পর্যাপ্ত আমদানি হচ্ছে। সংকটের কোনো কারণ নেই। আমরা বিগত দিনে দেখেছি দেশে ৫-৬টি কোম্পানি সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়াটা তাদের কৌশল। সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব দাম বাড়ানোর দেয়। এবারও সেটিই করা হচ্ছে। রমজানকে ঘিরে তারা এমন কারসাজি করছে। যা প্রতি বছরই করা হয়ে থাকে। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
কেকে/এআর