প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসকদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু। এটা আমাদের এখন এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। এখানে যেন আমরা বিফল না হই, কারণ এটাতেই আমাদের সব অর্জন। সব নাগরিকের সুরক্ষা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, আমরা এখন থেকে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করব, সেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও দেশের সব মানুষকে সুরক্ষা প্রদান করা। নারী ও শিশু এবং সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। কে কোন মতবাদে বা রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী সেটা বিবেচ্য নয়। কারণ সরকার দেশের সব মানুষের সরকার। তাই তাকে সুরক্ষা দেওয়া আমার কাজ।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে সজাগ থাকার নির্দেশ দেন তিনি। ড. ইউনূস বলেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া মস্ত বড় দায়িত্ব। এ ইস্যুতে সারা দুনিয়া নজর রাখছে আমাদের ওপরে। একটা ছোট্ট ঘটনা সারা দুনিয়ায় চাউর হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বলেছি আপনারা সংখ্যালঘু হিসেবে কোনো কিছু দাবি করবেন না, দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করবেন। কারণ দেশের নাগরিক হিসেবে সংবিধান আপনাকে যে অধিকার দিয়েছে সেই অধিকার রাষ্ট্রের কাছে আপনার প্রাপ্য। এটা দাবি নয়, আপনার পাওনা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটা নিয়ে জেলা প্রশাসকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে পারে কার জেলায় বাজারদর কতটা ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে। কোনো চাঁদাবাজি বা অন্য যেসব অসুবিধা থাকে সেগুলো দূর করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে এখন যে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগছে না, এ তথ্য মাঠে-ঘাটে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি হয়, এটি বন্ধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম সনদের মতো পাসপোর্ট পাওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার।
জন্ম সনদ একজন নাগরিকের অবশ্যই প্রাপ্য উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে কোনো বয়সে এবং যে কোনো সময়ে একজন নাগরিক জন্ম সনদ চাইতে পারে। তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জন্ম সনদ একজন নাগরিকের দালিলিক প্রমাণ যে ওই ব্যক্তি এই দেশের নাগরিক। কারণ এ জন্ম সনদ দিয়েই তার অন্যান্য কাজ করতে হবে। এটা না হলে জাতীয় পরিচয়পত্র হচ্ছে না, পাসপোর্ট হচ্ছে না। জন্ম সনদ পেতে একজন হয়রানির শিকার হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে।
সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি করার আহ্বান জানিয়ে জেলা প্রশাসকদের অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সৃজনশীল কাজ করার সুযোগ তোমাদের পুরো মাত্রায় রয়েছে। আশা করি তোমরা সেটা গ্রহণ করবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, বাজারদর নিয়ন্ত্রণ, জমির রেকর্ডপত্র থেকে শুরু করে অন্যান্য সেবা অনলাইনে প্রদান, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ সরকারি সেবাকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতা হতে পারে।
সরকারকে একটা ‘খেলার টিম’ অভিহিত করে অধ্যাপক ইউনূস জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে বলেন, সরকারকে যদি একটা ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে এটা একটি টিম। এ সরকারের ছয় মাস চলে গেল, এটাকে আমি বলছি সরকারের প্রথম পর্ব। প্রথম পর্বের কোনো ভুল থাকলে সেটাকে ঠিকঠাক করে এখন আমরা খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এখন কাজ হলো কর্মপদ্ধতি ঠিক করা। খেলা হলো একটা সামগ্রিক বিষয়, একজনের ভুলের কারণে অন্যরা সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। পুরো টিমের সাফল্যটা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। প্রস্তুতির কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করা দরকার।
প্রধান উপদেষ্টা জেলা প্রশাসকদের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নিজের মতো করে মাঠ প্রশাসন পরিচালনা করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি সরকার প্রধান বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অহেতুক স্তুতি বা প্রশংসা করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তী সরকারের কারো নামে কোনো স্থাপনা হবে না : শিক্ষা উপদেষ্টা
জেলা প্রশাসকদের নিজ নিজ শহরে বিশেষ বিশেষ কিছু নিদর্শন রেখে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের নামে কোথাও কোনো কিছু হবে না। এমনকি সরকারে যারা আছেন তারা কোথাও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতেও যাবেন না। গতকাল রোববার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের প্রথম দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্য-অধিবেশন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে সামনে নির্বাচন আসছে, সেই নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু করা যায় সেটিই আমাদের সরকারের প্রধান কাজ। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। তিনি বলেন, আরেকটা পরামর্শ দিয়েছি, যেহেতু তারা (জেলা প্রশাসকরা) নিজ নিজ এলাকায় ছোট একটি শহরে থাকেন, সে শহরগুলোতে আমরা ছোটবেলায় যা দেখেছি, তখনকার দিনে যারা জেলা প্রশাসক ছিলেন বা মহকুমার প্রশাসক ছিলেন তারা কিন্তু একটা কিছু (নিদর্শন) সেই শহরের জন্য রেখে যেতেন। সেটা হোক একটি সুন্দর দিঘি, স্টেডিয়াম, স্কুল বা একটি সুন্দর পার্ক। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিয়েছি আপনারা আপনাদের প্রতিটি শহরে যেখানে যে আছেন একটা কিছু আপনাদের নিদর্শন রেখে যাবেন।
পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগে বিশেষ উদ্যোগ
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে শূন্যপদ পূরণে ৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের প্রথম দিনের দ্বিতীয় কার্য-অধিবেশন শেষে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আমরা গত কয়েকদিনে স্পষ্ট দেখেছি যে, এন্ট্রি পদে প্রায় ৫ হাজারের বেশি পদে চিকিৎসক প্রয়োজন। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ পদ এবং অন্যান্য আধুনিক হাসপাতালগুলোতে আমাদের পদের প্রয়োজনীয়তা আছে। পদ সৃষ্টি এবং এর আর্থিক সংশ্লেষ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার পদ সৃষ্টির জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ইউনিয়নেও যেমন পদের ঘাটতি রয়েছে, তেমনি মেডিকেল কলেজেও রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে চেষ্টা করছি আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। অল্প দিনে যদি এ উদ্যোগটি সফল হয়; অল্প দিনে বিশেষ বন্দোবস্তে যদি আমরা নতুন পদে জনবল নিয়োগ করতে পারি; তখন এ সমস্যা থেকে উত্তরণ হবে।
কেকে/এআর