নুসরাতের বয়স মাত্র দেড় বছর আর আব্দুল্লাহ সাড়ে তিন। এতোটুকু বয়সে বাবা হারা এই অবুঝ দুই শিশু। রোজ রাতে বিছানায় বাবার অপেক্ষায় থাকে তারা। বাবার সাথে ঘুমাতে চায় দুজনই। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে বাবাকে না পেয়ে রোজই কান্না করে এই এতিম ভাইবোন। বলছিলাম জুলাই বিপ্লবে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া শহিদ হৃদয় মিয়ার অবুঝ সন্তান নুসরাত ও আব্দুল্লাহ'র কথা। বাবা হারা এতিম সন্তানদের একমাত্র সঙ্গী অসহায় মা শিরিনা আক্তার। স্বামীকে হারিয়ে দুই শিশু সন্তান নিয়ে বিপাকে এই নারী। স্বামী কিংবা বাবার বাড়িতে আর্থিক সক্ষমতা না থাকা শিশু সন্তানদের ভরনপোষণ ও ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে দুঃশ্চিতায় দিন কাটছে তার।
২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ মোড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে নিহত হন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের হৃদয় মিয়া। সে এলাকার ছফেদ আলীর ছেলে।
জানা যায়, বাবা মায়ের দাম্পত্য দ্বন্দ্বের কারনে ছোটবেলা থেকে নারায়ণগঞ্জে সিদ্ধিরগঞ্জের হাউজিং এলাকায় নানীর কাছেই থাকতেন হৃদয়। ২০২০ সালে ভালোবেসে শিরিনা আক্তারকে বিয়ে করেন হৃদয়। পেশায় সিলিং মিস্ত্রি হৃদয় মিয়া দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছিলেন।
ঘটনার দিন সকালে কাজের সন্ধানে ঘর থেকে বের হলেও রাতে ফিরেন লাশ হয়ে।
প্রতক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন বিকাল ৫ টার দিকে বাসায় ফিরছিলেন হৃদয়। আসার পথে সিদ্ধিরগঞ্জ মোড়ে ছাত্রজনতার আন্দোলন যোগ দেন । এসময় বিপরীত পাশ থেকে ছোঁড়া পুলিশের গুলী এসে লাগে হৃদয়ের কপালে। তৎক্ষণাৎ সড়কের লুটে পড়েন হৃদয়। স্থানীয়রা উদ্ধার করে নিয়ে আসলে বাঁচানো যায়নি হৃদয়কে। পুলিশের ভয়ে প্রতিবেশীরা রাতেই সিদ্ধিরগঞ্জ সিটিকর্পোরেশন কবরস্থান দাফন করেন হৃদয়কে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হৃদয়কে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন হৃদয়ের স্ত্রী শিরিনা আক্তার। স্বামীর মৃত্যুর পর বাবার ভাড়া বাসায় উঠলেও অসুস্থ বাবার পরিবারে বোঝার হয়ে রয়েছেন। কোনো উপার্জন না থাকায় অভাব অনটনে দিন কাটছে তার।
বাবাকে দেখতে প্রতিদিন আবদার করে সন্তানরা। চায় মজাদার খাবার। অবুঝ সন্তানদের আবদার মেটাতে না পারায় কষ্টের শেষ নেই শিরিনার।
শহিদ হৃদয়ের স্ত্রী শিরিনা আক্তার বলেন, আমার স্বামীর কলিজা ছিল তাঁর দুই সন্তান। প্রতিদিন কাজ থেকে ফেরার সময় তাদের জন্য ফলমূলসহ মজাদার খাবার নিয়ে আসতো। ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতেন। আমার ছেলে রাতে এখনো বাবার অপেক্ষা করে। বার জিজ্ঞাসা করে বাবা কবে আসবে। সকাল ঘুম থেকে উঠলে বাবাকে দেখতে চায় তারা। আমি এই কষ্ট আর নিতে পারছি না।
হৃদয়ের পরিবারে তেমন কেউ নেই। আমার বাবার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। দুই সন্তানকে নিয়ে আমি অকুল সাগরের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি।
হৃদয়কে হারিয়ে আমি বড় অসহায়। আমার আর্থিক কোনো সংস্থান নেই। ছোট ছোট বাচ্চাকে রেখে কোথায় কাজ করবো। কি করে বাকি দিনগুলো পার করবো সেই চিন্তায় রাতদিন কাটে না।
এদিকে শহীদ হৃদয়ের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সরকার সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা।
সুনামগঞ্জ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতা উসমান গণী বলেন, হৃদয় দেশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সরকারকে অবশ্যই হৃদয়ের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। হৃদয়ের পরিবার খুব মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা সব সময় তাঁর খোঁজখবর নিচ্ছি। সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে থাকছি। আমরা দাবি করবো হৃদয়ের মতো সুনামগঞ্জের যে বাসিন্দারা আহত অথব নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে স্থায়ি পুনবার্সনে আওতায় নিয়ে আসবে সরকার।
অপরিদকে শহীদ হৃদয়ের পরিবারকে ১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। পরবর্তী সরকারি সকল সহযোগিতার আওতায় হৃদয়ের পরিবারকে আনার আশ্বাসের কথা জানান সুনামগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম।
কেকে/ এমএস