‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে তিস্তা নদী পাড়ের ১১টি স্থানে গতকাল সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) থেকে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন।
এ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মানুষের ঢল নেমেছে শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা পাড়ে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুর বিভাগের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা এ ৫ জেলার ডিমলা, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, লালমনিরহাট সদর, গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, রাজারহাট, উলিপুর ও সুন্দরগঞ্জ এ ১০টি উপজেলার ১১টি স্পটে অবস্থান কর্মসূচি চলছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নের বুড়িরহাট ও উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের পাকার মাথা এলাকায় অবস্থান কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও।
তিস্তা পাড়ের মানুষ জানান, উত্তরের জীবন তিস্তা নদী। সেই নদী এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় ভাটির দিকে পানি নেই বললেই চলে। বইছে ক্ষীণ ধারা। আর বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিলে দু-কূল ছাপিয়ে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। এ নদীর পানি বাড়ার সময় পাড় ভাঙে আবার কমার সময়ও ভাঙে।
রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমীগর। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে ভারতের কাছে বাংলাদেশ থেকে অনেক কিছু বেচে দিয়েছে। কিন্তু তিস্তার এক ফোঁটা পানি আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শুধু তিস্তা নয় ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। বাঁধ দিয়ে তারা পানি তুলে নিয়ে যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর আমাদের দেশের মানুষ এখানে ফসল ফলাতে পারে না।
ভারতের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, যদি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব চান, তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ করুন। আমরা আমাদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই। আমরা অবশ্যই ভারতকে বন্ধুত্বের সঙ্গে দেখতে চাই। যে বন্ধুত্ব হবে সম্মানের সঙ্গে আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার। তিনি বলেন, তিস্তা বাঁচানোর ডাক আমাদের অন্তরের ডাক। আজকের এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচা-মরার সংগ্রাম। তিস্তাপাড়ের মানুষের এ সংগ্রামকে আবার কখনো বন্ধ হতে দেব না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, তিস্তা নিয়ে আপনাদের মুখ খুলতে হবে। ভারতকে বলতে হবে আমরা পানির ন্যায্য হিস্যা চাই।
রংপুর জেলার তিস্তা রেলওয়ে সেতু সংলগ্ন চরে আয়োজিত সমাবেশে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, শুকনো মৌসুমে ভারত উজানের পানি আটকে রাখে, আর বর্ষার মৌসুমে ছেড়ে দেয়। যার ফলে আমাদের এখানে বন্যায় সব ভেসে যায়। এটা কি বন্ধুর পরিচয়, কোনোভাবেই না। এবার তিস্তার লড়াই আমাদের জিততেই হবে, যদি এ জনপদের লোকদের বাঁচাতে চাই।
মির্জা ফখরুল পরে লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা রেলসেতু এলাকার অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেন। এ পয়েন্টে আরো উপস্থিত ছিলেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবীব দুলু, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান দুদু, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কণ্ঠশিল্পী বেবি নাজনীন, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক।
এদিকে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর সেতু পয়েন্টে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তিস্তা শুধু একটি নদী নয়, এটি এ অঞ্চলের লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
একই পয়েন্টে ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী। তিনি বলেন, তিস্তা নদীর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন হলে এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত তিস্তা পাড়ের মানুষ আজ ন্যায্য অধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ভারতের সঙ্গেই আমাদের হিস্যা, পানির হিস্যা। ওইটা আমরা আগে ফয়সালা করে নেব। আমাদের এ জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যাতে করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নিতে পারি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, উত্তরাঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। ভারতের কাছে নতি স্বীকার করব না, দেশের স্বার্থই সবার আগে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। আওয়ামী লীগ সরকার যে চীনের চুক্তি আটকে দিয়েছে, আমরা তা কার্যকর করব। বাঁধ নির্মাণ, খননকাজ ও উন্নত সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করে কৃষকদের জন্য সারা বছর পানি সরবরাহ করব। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর তিস্তা ব্রিজ পয়েন্টে আয়োজিত জনতার সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবীব দুলু বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদীর দুই তীরের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চলছে।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের বুড়িরহাট তিস্তা পাড়ের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলির সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমরা বিদেশিদের কাছে প্রভুত্ব চাই না, বন্ধুত্ব চাই। এ কথাটি প্রমাণ করার জন্যই তিস্তা পাড়ে আজকের এ সমাবেশ। তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক বন্ধুদের আমরা বলব, নিরপেক্ষ আচরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে তিস্তার এ ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি দিন।
ডালিয়া পয়েন্টে শতাধিক তাঁবু
নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় তিস্তা চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল দুপুর ২টা থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার কর্মসূচি শুরু হয়েছে। জেলার ৬ উপজেলা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এর আগে সকাল থেকে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে লোকজন জড়ো হন কর্মসূচিস্থলে।
অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের প্রধান দাবি, তিস্তা মেগা প্রকল্প আমরা অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন চাই। আর কোনো কালক্ষেপণ চাই না। আরেক অংশগ্রহণকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের যখন পানির প্রয়োজন নেই তখন পানি ছেড়ে দেয় ভারত। আর যখন পানির প্রয়োজন তখন পানি বন্ধ করে রাখে। আমরা এটা চাই না। আমরা চাই পানি সঠিকভাবে বণ্টন করা হোক ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন হোক।
এদিকে রাতে অবস্থানের জন্য ডিমলা উপজেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টের পশ্চিম দিকে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক তাঁবু। ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো তিস্তা ব্যারেজ এলাকা। তৈরি করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। বক্তব্যের পাশাপাশি চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নীলফামারী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল আলম জানান, মঙ্গলবার এ পয়েন্টে বক্তব্য রাখবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
তিস্তা ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত অন্যতম একটি অভিন্ন নদী। শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় সেটি গত এক দশকেও আলোর মুখ দেখেনি। অভিন্ন নদী হিসেবে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করে উজানে তিস্তার পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। ফলে এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ আছে।
কেকে/এআর