দেশের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অনন্য এক নজির জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে হাসিনাবিরোধী এ আন্দোলনে নিঃস্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনসহ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। আর এ আন্দোলন সফল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী নেতাকর্মীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন অনেকে। আবার কারো হয়েছে অঙ্গহানি, অনেকে এখনো হাসপাতালের বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরই মধ্যে আন্দোলনে আহত অনেকেই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনেও ফিরেছেন।
তবে, হাসিনার পতনের পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সেই নিঃস্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই মনোভাব। অনেকেই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ভুলে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে মরিয়া হয়ে উঠছেন। প্রকাশ পাচ্ছে দাবি-দাওয়া ও চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টিও। এরমধ্যে আন্দোলনে আহতদেরও নানা দাবিতে রাজপথে সরব হতে দেখা যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি চিকিৎসা, পুনর্বাসন, স্বীকৃতি, মাসিক ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের স্বজন ও আহতরা বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছেন। আর এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
বিষয়টি নিয়ে অনেকেই মনে করছেন গণঅভুত্থানের ৬ মাস পরও শহিদ এবং আহতদের যথাযথ সহযোগিতা নিশ্চিত না হওয়া এটি অবন্তর্বর্তী সরকারের একটি ব্যর্থতা। আবার কেউ কেউ মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকার শহিদ এবং আহতদের সহযোগিতার জন্য যে প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছেন এগুলো উপেক্ষা করে রাজপথে আন্দোলন করাটাও অনুচিত। তাদের ভাষ্য, আন্দোলনকারীদের অনেকেই জুলাইয়ের চেতনা ভুলে এখন নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফলে, কোনটা যোক্তিক এবং কোনটা অযৌক্তিক এ বিষয়টি আমলে না দিয়ে ফায়দা হাসিলের প্রতিই বেশি মনোযোগী হচ্ছে।
এদিকে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত প্রায় ১৩ হাজার ৮৪৮ জনের নাম তালিকাভুক্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে সহায়তা, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তিনটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ক্যাটাগরিগুলো পুনরায় সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ক্যাটাগরির ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়ন করে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
এরমেধ্যে, এ ক্যাটাগরিতে অতি গুরুতর আহত- যাদের আজীবন সাহায্যের আওতায় নিয়ে আসতে হবে (ন্যূনতম এক চোখ/হাত/পা ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অনুপযোগী, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, সম্পূর্ণভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাজ করতে অক্ষম বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি)।
বি ক্যাটেগরিতে গুরুতর আহত- যাদের দীর্ঘদিন সাহায্য দিতে হবে (আংশিক দৃষ্টিহীন, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি)। এছাড়া সি ক্যাটেগরিতে আহত যারা এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম হবেন (শ্রবণশক্তি/দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত, গুলিতে আহত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। আহত যারা ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম)।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম জানিয়েছেন, প্রত্যেক শহিদ পরিবার ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পাবে। আহতরা পরিচয়পত্রের পাশাপাশি আজীবন ভাতা ও চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। গুরুতর আহতরা (এ ক্যাটাগরি) এককালীন ৫ লাখ টাকা এবং প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন। আর যাদের এক অঙ্গহানি (বি ক্যাটাগরি) হয়েছে, তারা এককালীন ৩ লাখ টাকা এবং ১৫ হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা পাবেন। যারা সি ক্যাটাগরিতে আছেন তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা নেই। তবে তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে এসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে সড়ক অবরোধ করে ফের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শেষে লং মার্চের ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতরা। তবে কবে লং মার্চ করবেন সেই ঘোষণা দেননি তারা। সবার সঙ্গে আলোচনা করে লং মার্চ কর্মসূচি পরে তা জানানোর কথা বলেছেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া একজন।
এর আগে গতকাল সোমবার দুপুর ২টার দিকে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে বাংলামোটর অভিমুখী লেন অবরোধ করেন তারা। এতে ওই পথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- আহতদের দুইটি ক্যাটাগরিতে বিবেচনায় যারা স্থায়ীভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন তাদের মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা, এককালীন ভাতা এবং পরিবারে দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে সরকারি বা আধা-সরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আহতদের মধ্যে যারা সেরে উঠেছেন এবং কর্মক্ষম আছেন তাদের ১৫ হাজার টাকা মাসিক এবং এককালীন ভাতার ব্যবস্থা এবং সরকারি বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে যেখানে আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো হুমকি, হয়রানি বা হত্যাচেষ্টা হলে সর্বোচ্চ শান্তির বিধান থাকতে হবে। এছাড়া আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের মানসিক কাউন্সেলিং, হয়রানি প্রতিরোধ এবং সমস্যা সমাধানের জন্য টোল-ফ্রি হটলাইন চালুর দাবিও জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালেদ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশ কিছু দাবি নিয়ে তারা বিএসএমএমইউর সামনে সড়কে অবস্থান করছে। তবে মোড়ের অন্য লেনগুলো দিয়ে যান চলাচল করছে।’
কেকে/এআর