বই এক বিশাল জগত, যেখানে হারিয়ে যাওয়া যায়, আবার নিজেকে নতুন করে খুঁজেও পাওয়া যায়। বই আমাদের কল্পনাকে প্রসারিত করে, চিন্তাকে শাণিত করে এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে। হাসনাত আবদুল্লাহ এমনই এক বইপ্রেমী, যিনি বইকে ভালোবেসে গড়ে তুলেছেন নিজের আলাদা পরিচয়। যিনি সবার কাছে পরিচিত ‘বুকিশ হাসনাত’ নামে।
বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা কেবল নিজস্ব সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই; বরং তিনি চেষ্টা করছেন পুরো সমাজে বই পড়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। তার বই রিভিউ, গবেষণাধর্মী কনটেন্ট এবং পাঠকদের প্রতি উৎসাহের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় বুক রিভিউয়ার ও বইপ্রচারক।
হাসনাতের জন্ম বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কুলুবাড়ি গ্রামে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস-এ সিরামিক ইন্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন।
হাসনাতের বইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল শৈশবেই। তার বাবার সংগ্রহে ছিল অসংখ্য বই। সেখান থেকে যখন যা মন চাইত তা-ই পড়া হতো। এভাবে বইয়ের প্রতি এক অন্তহীন টান তৈরি হয়।
তবে জীবনে বড় পরিবর্তন আসে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়। এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে পড়া তিনটি বই তার জীবনে পরিবর্তন আনে। তখন থেকেই তিনি বই সংগ্রহ করা শুরু করেন এবং বিভিন্ন ধরণের বই পড়তে শুরু করেন—উপন্যাস, ইতিহাস, ধর্মীয় গ্রন্থ, আত্মজীবনী, রাজনীতি, দর্শন।
কিন্তু তার বইয়ের প্রতি আসক্তি নতুন মাত্রা পায় করোনা মহামারির সময়ে। যখন সারা বিশ্ব থমকে ছিল, তখন হাসনাত বইয়ের মধ্যে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নেন। প্রতিদিন বই পড়ে, নিজের জ্ঞানকে আরো বিস্তৃত করতে থাকেন।
২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসার পর তার জীবন এক নতুন মোড় নেয়। ঢাকার বইপ্রেমীদের সংগঠন ও বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই তার মাথায় আসে—নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়া উচিত।
ছবি : খোলা কাগজ
হঠাৎ একদিন ভাবলেন, যেসব বই তিনি পড়ছেন, সেগুলোর রিভিউ দিলে কেমন হয়? এই চিন্তা থেকেই গুলিস্তান থেকে মাত্র ৩০০ টাকায় একটা মাইক্রোফোন কিনে বই নিয়ে ভিডিও বানানোর কাজ শুরু করেন।
প্রথম দিকে মানুষ হাসাহাসি করত, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। মোবাইলের সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে কাজ চালালেও, ধীরে ধীরে ভিডিওর মান উন্নত করতে থাকেন।
এক সময় তার রিভিউ ও বই-বিষয়ক কনটেন্ট জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তার সাবলীল উপস্থাপনা, গভীর বিশ্লেষণ, এবং গল্প বলার অভিনব কৌশল দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
বর্তমানে ‘Bookish Hasnat’ নামে তার ফেসবুক পেজ হাজারো পাঠকের প্রিয় এক নাম। সেখানে তিনি নিয়মিত বই পর্যালোচনা, লেখকদের সাক্ষাৎকার, বইমেলা কভারেজ, স্টোরিটেলিংসহ বই সম্পর্কিত বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ বই নিয়ে যে কাজগুলো করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১. বুক রিভিউ : প্রতিটি বই পড়ার পর তিনি এর ভালো-মন্দ দিক তুলে ধরেন, কেন বইটি পড়া উচিত বা উচিত নয়, তা পাঠকদের জানান। তবে তিনি সবসময় ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করেন, কোনো পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন না।
২. বুক-রিলেটেড কনটেন্ট : এখানে তিনি পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, বইয়ের প্রতি পাঠকদের আগ্রহী করার জন্য মজার উপস্থাপনার মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি করেন।
৩. স্টোরিটেলিং : তিনি বিভিন্ন জনপ্রিয় গল্প বা উপন্যাসের প্রিয় অংশ পড়ে শোনান, যাতে পাঠকদের বই পড়ার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।
৪. লেখকদের সাক্ষাৎকার : একজন লেখকের মনোভাব, তার লেখা শুরু করার কারণ ও প্রক্রিয়া তুলে ধরার জন্য তিনি লেখকদের সাথে আলোচনা করেন এবং তাদের গল্প পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন।
৫. বুক-রিলেটেড ইনফরমেশনাল ডকুমেন্টারি : বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও স্থানকে কেন্দ্র করে তথ্যবহুল কনটেন্ট তৈরি করেন, যেমন বাংলাবাজারের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক, নীলক্ষেতে বই বিক্রির ইতিহাস ইত্যাদি।
৬. বইমেলা ভিত্তিক কনটেন্ট : বইমেলায় পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের সাথে মজার প্রশ্নোত্তর পর্ব, রিলস, লাইভ সেশন ও ডকুমেন্টারি তৈরি করেন।
ছবি : খোলা কাগজ
‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এ তিনি নবীন ও প্রবীণ লেখকদের বই নিয়ে কাজ করেছেন। বিভিন্ন লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং বইপ্রেমীদের জন্য দারুণ সব কনটেন্ট তৈরি করেছেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বাংলাদেশ বুকওয়ার্ম অ্যাসোসিয়েশন’ তাকে বুক রিভিউয়ার ক্যাটাগরিতে ‘সেরা বুক রিভিউয়ার’ সম্মাননা দিয়েছেন।