মার্কিন লেখক র্মাক টোয়েনের কথা দিয়েই শুরু করি; তিনি বলেছিলেন, “তিনি বৃদ্ধদের বিশ্বাস করেন না; বৃদ্ধ বা প্রবীণরা মিথ্যুক ও প্রতারক। তিনি শিশু ও কিশোরদের ভালোবাসেন।” কথাটা সরলীকরণ হয়ে গেছে; তবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের দিকে তাকালে তার কথার সত্যতা মেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক তরুণের জীবনদানের মধ্য দিয়ে তরুণরাই প্রথম ব্যাপকভাবে মাস্তানের রাজনীতির বিপক্ষে বুক চিতিয়ে শুধু দাঁড়ালেনই না একই সঙ্গে ঘর থেকে নিপাট অরাজনৈতিক ব্যক্তিকেও রাজপথে টেনে নিয়ে এলেন। মাস্তানের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক আলাপই ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাজনীতি থেকে বিমুখ মানুষকে রাজনৈতিক আলাপে যুক্ত করলেন। এখানে বৃদ্ধদের পারা, না-পারার বিষয়টি মূখ্য নয়, মূখ্য তরুণদের সবাই বিশ্বাস করতে পেরেছেন। তরুণরা যে ভাষায় আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছেন, যে ভাষায় ডাক দিয়েছেন তাকে বিশ্বাসও করেছে সবাই। কেন না, তারুণ্য বিক্রি হয় না, কারও কাছে মাথানত করে না। ফলে তরুণরা যে প্রতারণা করবেন এটি কেউ চিন্তাও করতে চাননি। এছাড়া ফ্যাসিস্ট শক্তিও তরুণদের শক্তিকে ভয় পেয়েছেন শুরু থেকেই।
বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের রাজনীতির দিকে তাকালে শুধু মাস্তানি, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর লুটপাটের চিত্রই পাওয়া যাবে। এ সময়টাতে এমন কোনো আদর্শ তরুণদের সামনে ছিল না, এমন কোনো সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন ছিল না, যা তাদের আন্দোলিত করে। এ না থাকার ভেতরও তারা নিজেদের তৈরি করলেন সবচেয়ে বড় অস্ত্ররূপে। যারা ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলতে পেরেছে, ‘তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া’। আমরা বদল চাই। এ ব্যবহার মধ্যে থাকতে চাই না। ফ্যাসিস্টকে বাধ্যও করল পালাতে। ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জনস্রোত, সেই স্রোতের ভেতর কিছু ইতিবাচক রাজনৈতিক চিন্তাকে তারা বইয়েও দিল। যদিও সেই স্রোত কোথায় গিয়ে মিশবে তার কোনো বড় ধরনের রূপরেখা এখন পর্যন্ত ছাত্ররা হাজির করতে পারেনি। বিশাল যে আত্মত্যাগের জাগরণ ঘটল তাকে জাগিয়ে রাখতে পারল না। বিভাজনের পথকেই বেছে নিলেন সবাই। তবে এক্ষেত্রে শুধু ছাত্রদেরই যে দোষ তাও না; ক্ষমতার মোহে আমাদের ভাবুকেরাও বিভ্রান্ত প্রচারে নেমে পড়লেন। সব মিলিয়ে বৃহৎ পরিবর্তনের যে আশা, তা বোধহয় বেশি দূর এগোবে না। মূল্যবোধ ধ্বংস করে আওয়ামী লীগ যে লাম্পট্যকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিষ্ঠা করেছে; তা থেকে রেহাই পেতে ‘সামাজ বিপ্লবের’ দরকার। আত্মজাগরণের স্রোতকে সমাজ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে দিতে পারছি না আমরা, তেমন কোনো লক্ষণও নেই। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের মানুষের ভাগ্যের নির্মম কৌতুকই বোধহয় এমন। সম্ভাবনার পথে এগিয়েও, বারবার ব্যর্থ হওয়াই তাদের স্বভাব যেন।
গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে চালু থাকা ফ্যাসিবাদি রাজনীতি এমনভাবে তাদের ভিত্তি গড়েছিল যে, তাদের টলানোর মতো শক্তি সহসাই কেউ দেখাতে পারবেন না বলে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। সে বিশ্বাসও ভেঙেছে। ৩ আগস্টও যারা বিশ্বাস করতে চাননি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। দুই দিন পরই তারাও হতবাক হলেন। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট দলের নেতাকর্মী, মন্ত্রিসভার সবাই হাওয়া হয়ে গেলেন। তুমুল এক ইমোশনকে সামনে রেখেই ছাত্রদের সামনে রেখে এটা ঘটাল দেশের অধিকাংশ মানুষ। পুরোনো সমাজ কাঠামোকে ভেঙে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন ছিল তাদের চোখে, তা না-হলে এত সাহস পেল কোথায় থেকে? তবে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এখন আর কাউকেই আত্মবিশ্বাসী হতে দেখা যাচ্ছে না। এখন প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি অর্জনের পথে দৌড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিত্ত আর বৈভবকে যে ব্যক্তির মূল্যায়নের মাপকাঠি বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ; লীগের সেই যাচাই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অনেকে লাইন ধরলেন। যাচাই প্রক্রিয়ার এই মহুয়া এমনই ভয়াবহ যে, জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে ব্যক্তি বদ্ধ উন্মাদও হয়ে যেতে পারেন। তার লক্ষণও ডালপালা মেলছে।
১৯৭১ সালে আমাদের সামনে সমাজ বিনির্মাণের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল; সে সুযোগকে নষ্ট করেছে আওয়ামী লীগ। যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি না থাকা দলটির নেতারা পালিয়ে গিয়েছিলেন পাশের দেশে, প্রাথমিক লড়াইটা করেছেন দেশের আপামর জনতা, বুক পেতে দিয়েছেন, মায়েরা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, কিন্তু যে লক্ষে লাখ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করলেন। সে লক্ষের সিকিভাগও বাস্তবায়ন হলো না। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সময়কার নির্বাচিত তাদের পলাতক প্রতিনিধিদের দেশে ফিরিয়ে এনে সরকার গঠন করলো। শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরে, তার ক্ষমতার রাজনীতিটাই করলেন। দেশের মানুষ কী চায়, কোন ইমোশনকে সামনে রেখে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিলেন- তা মূল্যায়ন করলেন না। সমাজকে রেখে দিলেন পুরোনো কাঠামোতেই। দেশের মানুষ ‘শুধু রামের বদলে শ্যামের রাজ্য পেল’। শাসকের পরিবর্তন হলো, মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। অবশ্য সব মানুষের ভাগ্য যে অপরিবর্তিত থেকেছে তাও নয়, আওয়ামী লীগারদের ভাগ্য বদলেছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে যেখানে কোনো কোটিপতি ছিলেন না, সেখানে আওয়ামী লীগের তিন বছরের শাসনে ভূরি ভূরি কোটিপতি জন্মালেন, ক্ষমতার সহচর্যে থেকে। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা নিয়ে জন্মানো সদ্য স্বাধীন দেশটিকে দখল-মাফিয়া-লুটপাট আর মাস্তানির বিরাট ক্ষেত্র বানানো হলো।
শ্রমিক ও কৃষকের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া সদ্য স্বাধীন দেশের সবটুকু সুফল পেল সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষেরা। অন্তজ থেকে গেলেন অধিকাংশই। একই ঘটনা ঘটল নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পরও। এবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও কী সেই একই পরিণতি অপেক্ষা করছে? এটি বলার সময় অবশ্য এখনো আসেনি। তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ দেখে মনে হচ্ছে, ধুলোপড়া কপালে হয়তো কছেশ ফোঁটা পানি পড়বে, তাতে কপালের পুরো ধুলো মুছে যাবে না।
তবে শুধু হতাশ হওয়ারই কিছু নেই। বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলেও, আওয়ামী লীগের মতো আর কেউ ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে পারবে না, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও একমত হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। সামনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে একটিমাত্র দলের। বিএনপির। দলটির বিরুদ্ধে নানা রকম সত্য-মিথ্যার বিষোদগারও রয়েছে। দুবার রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা বিএনপিকে ঘিরে বেশ কিছু বিতর্ক রয়েছে, তবে তার সত্য-মিথ্যা আপেক্ষিক। কেননা ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষকে এমনভাবে হাজির করে, যেন প্রতিপক্ষের মতো ফেরাউন আর দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। সেই আলাপে যাচ্ছি না। এত নিন্দা থাকার পরও দলটির বর্তমান নেতৃত্ব দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দলটি রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল বেশ আগেই। নতুন বাংলাদেশে আবারও দফাগুলো সামনে আনছে তারা। দফাগুলো যে কোনো মূল্যায়নে গণতান্ত্রিক ও সুন্দর একটি দেশ গঠনের ইশতেহার। এখন দেশের মানুষ যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েনও তবুও তাদের এ দফাগুলো নিয়ে সমালোচনা করা জরুরি। কারণ আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্ব বিএনপিই যে দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে দলটিকে জনগণের ভেতর থেকে সর্বদা চাপে রাখতে হবে বা বাধ্য করতে হবে, যেন তারা তাদের প্রতিশ্রুত দফাগুলো বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটিই কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে। ঝড়ের রাতে নিভু নিভু প্রদীপটিকে বাতাসের ঝাপ্টা থেকে রক্ষা করলে অন্তত আলোটুকু থেকে যায়। সে আলোটাই দিনের কাছে আমাদের পৌঁছে দিতে পারবে।
আমরা যে পরিবর্তন আশা করছি সেটি আমদানি করেও করা সম্ভব নয়, বা কেউ এসে আমাদের করেও দেবে না। আমাদেরই তা করতে হবে। এখানে ‘আমরা’ বলতে মূলত রাজনৈতিক বর্গই। রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক। আমাদের ভেতর যে আগুন জ্বলে উঠেছে অন্যায়কে পোড়াবে বলে, মাস্তানিকে পোড়াবে বলে- সে আগুনের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় আবার গৃহ পুড়তে শুরু করলে আমাদের মুক্তির ক্ষীণ আশাটুকুও চূড়ান্ত হতাশায় পর্যবসিত হবে। আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে হীন কোনো শক্তি। আবার জেঁকে বসবে ঘাড়ের ওপর। আর চাবুক মারবে, মুখে লাগাম পরিয়ে লাগাম টানবে, আমাদের টগবগ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করলেই আমরা আমাদের কর্তব্য ঠিক করতে পারব। ‘সমাজতন্ত্র নাকি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’ এমন বিতর্ক আমাদের শ্রমিকদের, কৃষকদের, মেহনতি মানুষদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচার সমাধান দেবে না। কেন না এ দুই তন্ত্রেরই কোনো বাস্তবতা নেই বাংলাদেশে। এ কথাটি সম্প্রতি বাংলাদেশের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক, লেখক, তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দেশে সমাজতন্ত্রের কোনো বাস্তবতা নেই, তেমনি নেই ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানের সম্ভাবনাও। বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে যায় এমন সংবিধান রচনা করতে হবে।’ এক্ষেত্রে একাত্তর এবং জুলাই বিপ্লবকে সামনে রাখলে খুব সহজ হবে আমাদের আগামীর গন্তব্য ঠিক করা। কোনো দল বা গোষ্ঠী যেন জনগণকে সুবিধাজনক হাতিয়ার বা আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে তাদের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ- সবকিছুই প্রতিষ্ঠা করতে হয় জনগণের নামে। আমরা যেন কারও চাপিয়ে দেওয়া মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার ঢাল হয়ে না উঠি সেদিকে নজর রাখতে হবে। এ সতর্কতা এবং হতাশ না হয়ে রাষ্ট্রের সব স্টেকদের জনদাবিকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য করতে পারলেই জুলাই বিপ্লবের সুফল পাব। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেখতে পাব।
কেকে/এমআই