চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরুর আগেই দলটির নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে। এ বিরোধ এতটাই প্রকাশ্যে এসেছে যে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পোস্ট দিচ্ছেন প্ল্যাটফর্মের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ।
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, নতুন এই দলের আহ্বায়ক হিসেবে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে মেনে নিয়েছে সব পক্ষই। তবে বাকি তিনটি পদে কারা আসবেন সেই প্রশ্নেই বিরোধ তৈরি হয়েছে। এই ইস্যুতে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে অন্তত চারটি বলয় তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
শিবির-সংশ্লিষ্টতার কারণে সংগঠনটির সাবেক নেতাদের শীর্ষ চারটি পদ থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন প্ল্যাটফর্মের শিবিরপন্থি একটি গ্রুপের নেতারা। জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাবেক সভাপতি রাফে সালমান রিফাত বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশে শিবির ট্যাগিং দেওয়া হতো। এখনো দেখছি আমাদের অতীত রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আমাদের ওপরের পদে যেতে বঞ্চিত করা হচ্ছে একই রকম ট্যাগিং করে।’
যে কারণে শিবিরপন্থিদের এই পক্ষটির কেউ কেউ জুলাই আন্দোলনে তাদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন। এরপরই এই বিষয়টি পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসে। ফলে আত্মপ্রকাশের আগেই কমিটি গঠন নিয়ে বিভক্তি ও বিরোধে অনেকটাই বিব্রত সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘আমি সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করছি। সবার ভেতরই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আছে। আশা করি সবার চেষ্টায় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সমন্বয়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংগঠিত করে দেশ পুনর্গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্ল্যাটফর্ম যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা রাজনৈতিক দল আনার ঘোষণাও দেয়। সেই রাজনৈতিক দল আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করার কথা রয়েছে। সেখানে শীর্ষ নেতৃত্বে কারা থাকবেন তা নিয়ে সংগঠনটিতে দফায় দফায় বৈঠকও হয়। ওইসব বৈঠকে বেশিরভাগ সদস্যই নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে জুলাই আন্দোলনের নেতা ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করার পরামর্শ দেন। এতে সম্মতিও রয়েছে নাহিদের।
আহ্বায়ক পদটি ছাড়াও নতুন রাজনৈতিক দলে আরো তিনটি শীর্ষ পদ রয়েছে। সেই পদগুলোয় কারা আসবেন সেটি নিয়ে গত কয়েকদিন দফায় দফায় আলোচনা হয় জাতীয় নাগরিক কমিটির মধ্যে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, মূলত ওই তিনটি পদের জন্য গত কয়েকদিন ধরে নানা ধরনের দর কষাকষি চলছে। নাগরিক কমিটির সদস্য সচিবের পদে থাকা আখতার হোসেনকে নতুন দলেও একই পদে রাখার জন্য সদস্যদের একটি পক্ষের চাপ রয়েছে। একই পদে সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর নামও প্রস্তাব করেছেন কেউ কেউ।
নাহিদ ইসলাম আহ্বায়ক হওয়ার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। যে কারণে বর্তমান আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীকে সদস্য সচিব করতে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা একজন ছাত্র প্রতিনিধি চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় একজন নেতা। এর বাইরেও নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি ও নাগরিক কমিটির বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জোনায়েদের নামও প্রস্তাব করছেন কেউ কেউ। নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘শীর্ষ পদে কারা থাকবেন সেটা নিয়ে যে কোনো রাজনৈতিক দলের একটা কনসার্ন থাকে। এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে অভ্যন্তরীণ ডেমোক্রেসি কেমন হবে সেটা দেখতে চাই আমরা।’
পদের ইস্যু ছাড়াও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা ইস্যুতে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে বলেও কেন্দ্রীয় কমিটির দুই জন নেতা জানিয়েছেন। নতুন দল চালুর আগেই কেন বিরোধের বিষয়গুলো সামনে আসছে এমন প্রশ্নও উঠেছে। জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘যারা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের নিয়েই দল গঠিত হবে। সেটি আশা করি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পাবে। এখানে সামান্যতম যে মত-দ্বিমত তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের মধ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনা চলছে।’
প্রথমে ছাত্র রাজনীতি করে আসা নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক ও আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়। নাগরিক কমিটি যখন ধীরে ধীরে তাদের পরিসর বড় করতে শুরু করে তখন তাতে যোগ দেন বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, রাষ্ট্রচিন্তার অনেকে। পাশাপাশি ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্র শক্তি, ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্র মজলিসহ কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের অনেকেও যোগ দেন এই প্ল্যাটফর্মে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে থাকা বিভিন্ন অ্যাক্টিভিস্টও এতে যুক্ত হন। আবার কোনো ধরনের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন না এমন কয়েকজন ব্যক্তিকেও ব্যক্তিগত যোগাযোগের ভিত্তিতে নাগরিক কমিটির সদস্য করা হয় বলে আলোচনা আছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে কেন্দ্র করে এ ছাত্র নেতৃত্ব চারটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে গত কয়েকদিনে। এর মধ্যে শক্তিশালী দুটি বলয়ের একটিতে রয়েছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি থেকে আসা নেতারা। আরেকটিতে রয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির ও বিভিন্ন ইসলামী দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক নেতারা।
নতুন রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, মুখ্য সংগঠক ও মুখপাত্র শীর্ষ এ চারটি পদ নিয়ে আগ্রহ সব গ্রুপের। এর মধ্যে নাহিদ ইসলামের আহ্বায়ক হওয়ার বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত হওয়ায় বাকি তিনটি পদের মধ্যে অন্তত একটি পদ পেতে চান কমিটিতে থাকা সাবেক শিবির নেতারা।
কেন্দ্রীয় কমিটি থাকা শিবিরের সাবেক একজন নেতা (নাম প্রকাশ করতে চাননি) বলেছেন, তারা এ বিষয়টি যখন নাগরিক কমিটির অভ্যন্তরীণ বৈঠকে তুলেছে তখন ‘শিবির’ পরিচয়ের কারণে তাদের শীর্ষ চারটি পদে না আনতে প্রভাবশালী একটি পক্ষ আপত্তি তুলেছেন।
মূলত ওই ঘটনার পরই রোববার নাগরিক কমিটির কমিটিতে থাকা সাবেক শিবির নেতাদের কেউ কেউ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের ভূমিকার বিষয়গুলো তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট দেন। যে কারণে এই ইস্যুটি গত কয়েকদিনে বিষয়টি নাগরিক কমিটির অভ্যন্তরে থাকলেও তা প্রকাশ্যে রূপ নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব রাফে সালমান রিফাত বলেন, ‘এখানে একটা অংশ ক্ষমতায়িত হচ্ছে, আরেকটা অংশ বঞ্চিত হচ্ছে। এটা তো ন্যায্যতার প্রশ্ন। ফলে ভেতরের সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো একটা সময় বাইরে চলে আসছে।’ দল শুরুর আগেই দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় এই বিষয়টি নিয়ে অনেকটা বিব্রত জাতীয় নাগরিক কমিটি। মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘তারা বিষয়গুলো এমন পাবলিক ফোরামে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে সমাধানের চেয়ে বেশি সমস্যাই তৈরি করছে। তাদের ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না সেটার ব্যাপারেও আমাদের ফোরাম আলাপ করেছে। এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’
কেকে/এআর