বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘ আওয়ামী শাসনের পতন হয়। ওই শাসন আমলে গড়ে ওঠা সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ছাত্র-জনতা। তাদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী সরকার। এর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় নতুন এক বাংলাদেশের।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে আসছে নতুন দল। সেই দলে পদ-পদবি নিয়ে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ। অভিযোগ রয়েছে, কমিটি করার ক্ষেত্রে বৈষম্য করছেন নেতারা। আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই বঞ্চিত থাকছেন। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিতেও যোগ্যরা স্থান পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। এমনকি আন্দোলনে শহিদদের প্রাপ্য সম্মানের জন্যও স্বজনদের এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত কমিটি ‘একপাক্ষিক’ আখ্যা দিয়ে চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগরসহ লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি থেকে বহু সদস্য পদত্যাগ করেছেন।
একইসঙ্গে কেন্দ্র ঘোষিত কমিটি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর কমিটি থেকে শতাধিক সদস্য পদত্যাগ করেছেন। ঘোষিত তিন কমিটি ‘একপাক্ষিক’ আখ্যা দিয়ে কমিটিগুলোকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন কমিটি গঠনে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন সংগঠনটির একাধিক সদস্য। এদিকে, ঘোষিত তিন কমিটি বাতিলের দাবিতে নগরীর লালখান বাজার মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন একাংশের শিক্ষার্থীরা। গত মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের আন্দোলনকারীরা। গত সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় কমিটি আগামী ছয় মাসের জন্য চট্টগ্রাম মহানগরে ৩১৫, জেলা উত্তরে ১১২ ও দক্ষিণ জেলায় ৩২৭ সদস্যবিশিষ্ট পৃথক কমিটির অনুমোদন দেয়। এরপর থেকে ঘোষিত নতুন কমিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়করা বলেন, ‘যারা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেনি এবং সম্মুখ সারিতে ছিলেন না তাদেরই কমিটির প্রধান পদে রাখা হয়েছে। অথচ যারা চট্টগ্রামে আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে ছিলেন তাদের মাইনাস করেই এ কমিটি দেওয়া হয়। আন্দোলনের সময় না থেকে যারা গত ৬ মাসে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তাদেরই স্থান দিয়েছে কেন্দ্র।
সমন্বয়ক জুবায়ের মানিক বলেন, ঘোষিত তিনটি কমিটি প্রহসনের। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের মূল্যায়ন করা হয়নি। বরং চাঁদাবাজ, ব্যবসায়ী, নারী হেনস্তাকারী ও কিশোর গ্যাং সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রাতে কমিটি, সকালেই ২৮ জনের পদত্যাগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি। গত রোববার রাতে ৬ মাসের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ২৩৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি অনুমোদন দেন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সদস্য সচিব আরিফ সোহেল।
তবে সোমবার দুপুরে এ কমিটি থেকে ২৮ জন পদত্যাগ করেছে। একইসঙ্গে কেন্দ্র ঘোষিত কমিটি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ কমিটি ভেঙে নতুন করে ঘোষণা করার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছেন পদত্যাগকারীরা। দুপুরে লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ ও আল্টিমেটামের বিষয় জানায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রদের একাংশ। কমিটির আহ্বায়ক আরমান হোসেন জানান, পদত্যাগকারীদের বিষয়ে আপাতত কোনো বক্তব্য নেই। পরবর্তীতে এ নিয়ে গণমাধ্যমকে বিবৃতি দেওয়া হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবি শাখার কমিটিতেই বৈষম্য
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন দুজন পদপ্রাপ্ত নেতা। গত বৃহস্পতিবার এ কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে কমিটিতে নাম থাকা কয়েকজন নেতা যোগ্য পদ না পাওয়ার কারণে পদত্যাগ করে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে কমিটির বিরোধিতা করছেন। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীদের মতে, যোগ্যদের বাদ দিয়ে একদল মানুষ সুবিধা গ্রহণের উদ্দেশ্যে এ কমিটি গঠন করেছে। তা ছাড়া পদবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নামে বৈষম্যবিরোধী হলেও জগন্নাথের কমিটিতে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন অনেকেই। অনেকে আন্দোলন করেও পদ পাননি বলে মন্তব্য করেছেন।
পদত্যাগ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন জবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শাহিন মিয়া। তিনি বলেন, ‘জবিতে দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি মূলত পদত্যাগ করা এক সমন্বয়কের পছন্দের লোকদের নিয়ে করা হয়েছে। এখানে কোনো ধরনের যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হয়নি। এ ব্যক্তিগত কমিটি মানি না এবং প্রত্যাখ্যান করছি।
সিরাজগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
সিরাজগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ২৮৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে বিপাকে পড়ে কেন্দ্র। গত ৮ ফেব্রুয়ারি কমিটি ঘোষণার পর তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে ছাত্রদের একটি পক্ষ। মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধের পর ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে সেই কমিটি স্থগিত করে কেন্দ্র। এরপর স্থগিত কমিটি বহালের দাবিতে ১১ ফেব্রুয়ারি মহাসড়ক অবরোধের ঘোষণা দেয় অপরপক্ষ। কমিটিতে সজীব সরকারকে আহ্বায়ক, মেহেদী হাসানকে সদস্যসচিব, ইকবাল হোসেনকে মুখ্য সংগঠক ও টি এম মুশফিককে মুখপাত্র করা হয়। এরপর কমিটিতে ত্যাগীদের বাদ দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে একপক্ষ আন্দোলনে নামে।
শিক্ষার্থীরা জানান, গত বছরের ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১১ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি করা হয়। মূলত সেই কমিটির নেতৃত্বে জেলায় আন্দোলন পরিচালিত হয়। ওই ১১ জনের কয়েকজনকে ঘোষিত কমিটিতে রাখা হয়নি। এর জেরে ওই কমিটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহতরাই বৈষম্যের শিকার
গণঅভ্যুত্থানের নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দাবি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিরাই এখন সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নিহত ব্যক্তিদের রক্তের বিনিময়ে কেউ কেউ পদ পেয়েছেন, উপদেষ্টা হয়েছেন। কিন্তু শহিদদের প্রাপ্য সম্মানের জন্যও তাদের স্বজনদের এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ২৩ জানুয়ারি এক মানববন্ধনে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা এ কথাগুলো বলেন। ‘জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত সকল শহিদ পরিবার’ এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।
আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই রামপুরায় নিহত রাসেল মিয়ার স্ত্রী শারমিন আক্তার বলেন, ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনে গেলে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলা হয় যে আমরা দান-ভিক্ষার জন্য গেছি। আমরা কেন ভিক্ষা নেব? আপনারা আমাদের সম্মানস্বরূপ অর্থ প্রদান করবেন। আমরা কারো কাছে দান-ভিক্ষা চাইনি।’
মানববন্ধনে অন্য শহিদ পরিবারের সদস্যরা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে শুধু সরকার পরিবর্তন, আমলা পরিবর্তন হয়েছে। আর কোনো কিছুরই কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো সিস্টেমের পরিবর্তন হয়নি। যদি পরিবর্তন হতো তাহলে শহিদ পরিবারের সদস্যদের অসম্মানিত হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন, মানববন্ধন করতে হতো না।
কেকে/এআর