রাজধানীতে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া বেড়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপরাধীরা দাপটের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবহার করছে। খুনখারাবি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখল, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একের পর এক ছিনতাই, সন্ত্রাসী ঘটনায় রাতে ঢাকায় ভয়-আতঙ্ক নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে নাগরিকদের।
পুলিশের তথ্যমতে, গত দুই মাসের তুলনায় রাজধানীতে অস্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। চলতি মাসে অন্তত ৫০টি ঘটনায় দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কঠোর অভিযান ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং অপরাধীদের অবাধে অস্ত্র ব্যবহার চলমান থাকলে পর্যায়ক্রমে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি। এগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের কাছেও রয়েছে। জননিরাপত্তা রক্ষায় এসব অস্ত্র দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনের পরবর্তীতে অপরাধপ্রবণ মানুষের সাহস বেড়েছে।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় গত সোমবার কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রকাশ্যে এক নারী-পুরুষকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে। মোটরসাইকেলের উচ্চগতির প্রতিবাদ করায় এই হামলা হয়। পরদিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শ্রমিক দলের নেতা জুয়েলকে গুলি করে তারই দলের আরেকটি গ্রুপ। বুধবার উত্তরা এলাকায় একটি চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
গত বেশ কিছু দিনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের আঘাতে নারী, শিশু ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ মারা যাচ্ছেন। শুধু ছিনতাই নয়-চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল, আধিপত্য বিস্তার এবং রাজনৈতিক বিরোধেও অস্ত্রের ব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর হামলার ঘটনার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা গেছে, দ্বন্দ্ব বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সশস্ত্র ব্যক্তিরা জনবহুল সড়ক, বাজার কিংবা আবাসিক এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা বা হুমকি দেওয়ার দৃশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পথচারী, দোকানি ও সাধারণ নাগরিকরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ যে কেউ অস্ত্রের আঘাতে হতাহতের শিকার হচ্ছেন।
রাজধানীর উত্তরায় গত সোমবার রাতে মেহেবুল হাসান ও নাসরিন আক্তার ইপ্তি নামের দুজনকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর সড়কে এ ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে বিষয়টি ধরা পড়ে।
এদিকে গত বুধবার সকালে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় ভিক্টর পরিবহন নামের একটি চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে পুরো ঘটনার বিবরণ দেন এক ভুক্তভোগী নারী। ওই নারীর ভাষ্যমতে, উত্তরা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। এসময় ৫-৬ জন যুবক বাসে উঠে ছুরি বের করে চিৎকার করে বলে, ‘সবাই চুপ, যা আছে বের করে দে।’ মুহূর্তের মধ্যেই তারা যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল, ওয়ালেটসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইকারীরা এক যাত্রীকে ছুরিকাঘাতও করে।
রাজধানীর বনশ্রীতে হেলমেট পরিহিত অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের গুলিতে জুয়েল সরদার (৪০) নামের শ্রমিক দল নেতা আহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাতে রামপুরা থানাধীন ওই এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। জুয়েল রামপুরা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। আহত জুয়েলকে হাসপাতালে নিয়ে আসা বন্ধু মহসিন জানান, কয়েক বন্ধু মিলে আড্ডা দেওয়ার সময় তিনটি মোটরসাইকেলে হেলমেট পরিহিত বেশ কয়েকজন এসে হিমেল নামের একজনের খোঁজ করেন। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা জুয়েলের ডান উরুতে গুলি করে চলে যান।
গত বুধবার মধ্যরাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে যৌথবাহিনীর সঙ্গে ‘গোলাগুলি’র সময় জুম্মন (২৫) ও মিরাজ হোসেন (২৬) নামে দুই ব্যক্তি নিহত হন। এ সময় অস্ত্র-গুলিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরআগে গত রোববার সন্ধ্যার দিকে মোহাম্মদপুরে দিনের আলোতেই প্রকাশ্যে পিস্তল বের করে পথচারীকে হুমকির ঘটনা ঘটে। মোহাম্মদপুর শের শাহ্ সুরি রোডের ঈদগাহ মাঠের পূর্ব দক্ষিণ কর্নারে এ ঘটনা ঘটে। পিস্তল হাতে ব্যক্তি ৩১ নম্বর ওয়ার্ড জাতীয় পার্টির কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম সেন্টুর বড় ভাই।
কিশোরদের নিয়ে গড়ে উঠছে অপরাধ সাম্রাজ্য
আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। ঢাকার মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, নানা কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। প্রথমে তুচ্ছ এবং পরে বড় অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে। গডফাদাররা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
এখনো উদ্ধার হয়নি ১৪০০ অস্ত্র, আড়াই লাখ গুলি
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আবদুল হাফিজ বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে লুট হওয়া এক হাজার ৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। পাশাপাশি আড়াই লাখ বিভিন্ন ধরনের গুলি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বলেন, ‘বাকি অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সহযোগিতা করতে হবে।’
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ‘কঠোর অবস্থানে সরকার’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রাজধানীসহ সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করছে।’
কেকে/এআর