দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে অপারেশ ডেভিল হান্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত এ অভিযানে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে চলমান এ অপারেশনের মধ্যেও থেমে নেই দুষ্কৃতকারীরা। রাজধানীসহ সারা দেশে সক্রিয় রয়েছে অপরাধচক্র। এতে প্রশ্ন উঠেছে, কতটা কাজে আসছে ‘ডেভিল’ ধরার এ অপারেশন।
যৌথবাহিনীর অভিযানের মধ্যেও গত সোমবার রাতে ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটে ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া একটি বাসে। এ সময় নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটে। এদিকে গত শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় প্রকাশ্যে ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া ডাকাতের ভয়ে ভৈরব-তাহিরপুরে নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়ও প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে কিশোর গ্যাং, ঘটেছে ডাকাতির ঘটনাও।
বিষয়টি নিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, অপারেশন ডেভিল হান্ট চলার সময় এরকম নৈরাজ্য নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার এবং দুশ্চিন্তার। তার অর্থ হচ্ছে, ডেভিল হান্ট কোনো কার্যকর ভূমিকায় আসছে না। আমরা প্রতিদিন দেখছি যে গ্রেফতারের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু অপরাধ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আতঙ্কের জায়গাটা এখানে।
সাইফুল হক আরো বলেন, মোহাম্মদপুরে দেখলাম যৌথ অভিযান চালাতে গিয়ে দুজন মারা গেছে, এ রকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকণ্ডের যে কালো অধ্যায় আমরা পার হয়ে এসেছি, তা যদি আবার দেখতে হয়, তাহলে এটা কিন্তু খুবই অনাকাক্সিক্ষত এবং নতুন করে নানা ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। আমরা কোনো অজুহাতেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না।
অভিযান আরো আগেই শুরু করার দরকার ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে অভিযান আরো পাঁচ-ছয় মাস আগে শুরু করার দরকার ছিল, তা দেরিতে করার কারণে বড় ডেভিলরা পালিয়ে গেছে বা আত্মোগোপনে চলে গেছে। এখন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ছিঁচকে সন্ত্রাসী বা ছিনতাইকারী ধরা পড়ছে। এটা করতে যেয়ে মানুষের নিরাপত্তার পরিবর্তে জনআতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। এটা দুশ্চিন্তার বিষয়। সমগ্র বিষয়টা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যালোচনা করা দরকার। ডেভিল হান্ট জনজীবনে শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।
রাজধানীতেও বেপরোয়া সন্ত্রসীরা
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় গত সোমবার কিশোর গ্যাং সদস্যরা প্রকাশ্যে এক নারী-পুরুষকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। মোটরসাইকেলের উচ্চগতির প্রতিবাদ করায় এ হামলা হয়। পরদিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শ্রমিক দলের নেতা জুয়েলকে গুলি করে তারই দলের আরেকটি গ্রুপ। বুধবার উত্তরা এলাকায় একটি চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর হামলার ঘটনার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা গেছে, সশস্ত্র ব্যক্তিরা জনবহুল সড়ক, বাজার কিংবা আবাসিক এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করছেন। এদিকে গত বুধবার সকালে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় ভিক্টর পরিবহন নামের একটি চলন্ত বাসে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর আগে গত রোববার সন্ধ্যার দিকে মোহাম্মদপুরে দিনের আলোতেই প্রকাশ্যে পিস্তল বের করে পথচারীকে হুমকির ঘটনা ঘটে। মোহাম্মদপুর শের শাহ্ সুরি রোডের ঈদগাহ মাঠের পূর্ব দক্ষিণ কর্নারে এ ঘটনা ঘটে।
তিনজনকে গুলি করে হত্যা : গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর এলাকায় ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বলে জানা গেছে। শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান জানান, বুকে ও মাথায় গুলি করে ওই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ কাজ করছে। এ বিষয়ে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। পরে হত্যার বিষয়ে চরমপন্থি সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু দায় স্বীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠান। পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী কুখ্যাত ডাকাত বাহিনীর শীর্ষ নেতা অসংখ্য খুন, গুম, দখলদারি, ডাকাতি, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হরিণাকুণ্ডুনিবাসী হানিফ তার দুই সহযোগীসহ জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন।
বাসে ডাকাতি ও নারীর শ্লীলতাহানী : এর আগে গত সোমবার রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকার মধ্যে এই ডাকাতি হয়েছে। বাসযাত্রীরা বলছেন, ৪০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে সোমবার রাত ১১টায় ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে বাসটি ছাড়ে। রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে বাসে ডাকাতি শুরু হয়। এ সময় বাসে থাকা দুই যাত্রীর শ্লীলতাহানিও করা হয়। তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতি শেষে ঘুরিয়ে একই জায়গায় বাসটি নিয়ে গিয়ে রাত ৩টা ৫২ মিনিটে ডাকাতরা নেমে যান। তখন যাত্রীরা দেখতে পান, তাদের অবস্থান মির্জাপুর থানা এলাকার একটি পেট্রোলপাম্পের পশ্চিম দিকে। সেখানে বাসচালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজার গন্তব্যে না যেতে নানা টালবাহানা করতে থাকেন। তবে যাত্রীদের চাপের মুখে তারা বাস ছাড়েন। মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে বাসটি যাত্রীদের চাপের মুখে বড়াইগ্রামে থানায় ঢোকানো হয়। তবে তাৎক্ষণিত মামলা নেয়নি পুলিশ। এ ঘটনার তিন দিন পর থানায় মামলা নেওয়া হয়। মামলার পর ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার : এদিকে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় মহান শহিদ দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল সংগ্রহ করতে যাওয়া এক স্কুলছাত্রী (১১) ধর্ষণের শিকার হয়। গত শুক্রবার সকালে উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মিঠাপুকুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবার। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
ডাকাতের ভয়ে ভৈরব-তাহিরপুরে নৌ চলাচল বন্ধ : ডাকাতির ভয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব ঘাটে নৌযান নোঙর করে ধর্মঘট করেছেন মাঝিরা। গতকাল শনিবার সকাল থেকে উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের খলাপাড়া ঘাটে মালামাল বহনকারী ১৫-২০টি নৌকা ঘাটে নোঙর করে রাখা হয়েছে। ঘাটে নৌঙর করা নৌকা ও বাল্কহেডের মাঝিরা অভিযোগ করে জানান, ঘাট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বাদাঘাট, বিশম্ভপুর এলাকায় বিভিন্ন মালামাল নিয়ে ৩০-৪০ নৌকা ও কার্গো চলাচল করে। শনিবার ভোরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বাদাঘাটের দিকে মালবাহী ১৫-২০টি নৌকা ও কার্গো যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথে বাজিতপুর উপজেলা পাটুলীঘাটে যাওয়ার পর একদল ডাকাত দুটি বল্কহেড আটকে তেলের ড্রাম, সিগারেটসহ প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যান। এসময় কয়েকজন আহত হয়েছেন। নৌঘাটের ইজারাদার খোকা মিয়া বলেন, নৌকার মাঝিরা আমার কাছে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছে। ডাকাতি প্রসঙ্গে আমি আশুগঞ্জ ও ভৈরব নৌ-পুলিশকে অবগত করেছি। ডাকাতির জন্য ভৈরব থেকে তাহিরপুর বাদাঘাটের নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে।
কেকে/এআর