চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাগানবাজার ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে আব্দুস শুক্কুর। সে পেশায় একজন গ্রাম পুলিশ হলেও চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত বসু মিয়াকে পিতা সাজিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে সরকারি কোষাগারের লাখ লাখ টাকা। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এমন অনিয়মের সাথে জড়িত থাকলেও তার ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কারোরই।
অভিযোগ আছে, তার এ অপকর্মের পেছনে জড়িত স্বয়ং বাগানবাজার ইউনিয়নের প্রশাসনিক কর্মকর্তা(সচিব) মো. বখতিয়ার উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি চক্র। চক্রটির কল্যাণে গ্রাম পুলিশ আব্দুস শুক্কুর তৈরি করে নেন দুইটি এনআইডি কার্ড, জাল ওয়ারিশন সনদপত্র, মুক্তিযোদ্ধার ভাতা কার্ডসহ নানাবিধ নথিপত্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের ছয় সন্তানের মধ্যে আব্দুস শুক্কুর তৃতীয় সন্তান। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাকের ভাই আরেক মুক্তিযোদ্ধা মৃত বসু মিয়ার সংসারে কোন সন্তান ছিল না। বসু মিয়ার মৃত্যুর পর মারা যান তাঁর স্ত্রীও।
২০১৪ সালে এই আব্দুর শুক্কুর তার সন্তানহীন চাচা বসু মিয়াকে পিতা সাজিয়ে তৈরি করেন অপর একটি এনআইডি। এই এনআইডি তৈরির কাজে তাঁকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করে সহায়তা করেন ইউপি সচিব বখতিয়ার উদ্দিন। আর নির্বাচন অফিস থেকে এনআইডি ইস্যুতে সহায়তা করেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব নুরুল ইসলাম ভুঁইয়ার ছোটভাই পল্লী চিকিৎসক ও এনআইডি জালিয়াতির অন্যতম হোতা শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া। এ জন্য শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া ৫০ হাজার টাকা নেন বলে জানান চৌকিদার শুক্কুর।
এই দুটি ভুয়া এনআইডিকে পুঁজি করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাল ওয়ারিশন সনদ নিয়ে আব্দুর শুক্কুর বনে যায় সন্তানহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত বসু মিয়ার একমাত্র সন্তান। যার পুঁজিতে চৌকিদার শুক্কুর ২০১৫ সাল থেকে উত্তোলন করে আসছে বসু মিয়ার নামে বরাদ্দকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভাতার অর্থ। যার ভাগ চলে যায় ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বখতিয়ার উদ্দিন, নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব নুরুল ইসলাম ভুঁইয়ার ছোটভাই পল্লী চিকিৎসক ও এনআইডি জালিয়াতির অন্যতম হোতা শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়াসহ চক্রের অন্যান্য সদস্যের কাছে। অভিযোগের দায় স্বীকার করে চৌকিদার আব্দুস শুক্কুর বলেন, ‘ভাতার টাকা উত্তোলন করে সচিবকে দিতে হয় ৫ হাজার, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে ২ হাজার ও ডাক্তার শহীদকে দিতে হয় ২ হাজার টাকা। বাকি টাকা নিজের সংসারের কাজে খরচ করেছি।’
এনআইডির মাধ্যমে ওয়ারিশন সনদ নিয়ে চাচা বসু মিয়াকে আপন পিতা সাজিয়ে বছরের পর বছর সরকারী কোষাগারের বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সচিব বখতিয়ারের নেতৃত্ব এ চক্রটি। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বিগত ১৪ বছর ধরে সচিব বখতিয়ার উদ্দিন বাগানবাজার ইউনিয়ন পরিষদে গড়ে তুলেছেন এনআইডি, ওয়ারিশান সনদ জালিয়াতিসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডের সাম্রাজ্য।
এ বিষয়ে জানতে ইউপি সচিব বখতিয়ার উদ্দিনের মুখোমুখি হলে সচিবের লালিত মাস্তানদের তোপের মুখে পড়তে হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। পরে অবশ্য তিনি নিজের দায় অন্যের ঘারে চাপানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এর আগে, সচিব বখতিয়ার চৌকিদার আব্দুর শুক্কুরকে বাঁচাতে গত ৬ জানুয়ারী পরিষদের প্রশাসকের স্বাক্ষরবিহীন নতুন আরেকটি প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করেন। যেখানে সচিব, ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম ও মহিলা ইউপি সদস্য শাহেনা বেগমের স্বাক্ষর দেখা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইউএনও নির্দেশে দুই ইউপি সদস্যের স্বাক্ষরে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছে।’
স্বাক্ষর করার বিষয়ে মহিলা ইউপি সদস্য শাহেনা বেগম বলেন, ‘সচিব বখতিয়ার শুক্কুরের এনআইডি স্থানান্তরের কথা বলে আমার সই নিয়েছে।’
এদিকে সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে বাগান বাজার ইউনিয়নের এনআইডি জালিয়াতি চক্রের সদস্য রাসেলকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দিলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এ অপকর্মের মাষ্টার মাইন্ড ইউপি সচিব বখতিয়ার।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সচিব বখতিয়ার দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বাগান বাজার ইউনিয়নের সচিব হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় একই ইউনিয়নে কর্মরত থাকার সুবাধে সচিব বখতিয়ার সেখানে গড়ে তুলেছেন ভুয়া এনআইডি জালিয়াতি চক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রয়োজনীয় সকল নথি সরবরাহ এবং ইস্যু করে সিন্ডিকেট সদস্যদের মাধ্যমে জাল এনআইডি তৈরিতে সহায়তা করেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এ ছাড়া নানা সময়ে ইউনিয়নের তুলনামূলক দরিদ্র লোকজনের ওয়ারিশন সনদ জাল করে প্রতিপক্ষকে সম্পদ হাতিয়ে নিতে সহায়তা করেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম মেম্বার বলেন, ‘সচিবের এসব অনিয়মের বিষয়ে আগামী মাসিক সভায় ইউনিয়নের প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক চৌধুরীকে অবহিত করা হবে।’
স্থানীয় বিএনপি নেতা লোকমান হোসেন বলেন, ‘সচিব বখতিয়ার নানা অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার ফলে এখানাকার মানুষ কাংখিত মানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সচিব বখতিয়ার এখানে গড়ে তুলেছেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য। এসব বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান তিনি।’
সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারের বিপুলসংখ্যক অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বিস্মিত ফটিকছড়ি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আলী আহমদ মাস্টার।
এনআইডি জালিয়াতি ও সরকারী কোষাগারের অর্থ আত্মসাৎ চক্রের এসব অনিয়মের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাগানবাজার ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনাটি জেনে ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দুইদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনার সত্যতা পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করা হবে।’
কেকে/ এমএস