রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর আজ। সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন বাহিনীর কয়েকশ সদস্য, ঢাকার বিদ্রোহ ছড়ায় সারা দেশের বিডিআরের দফতরগুলোতে। ২০০৯ সালের এই দিনে হত্যাকাণ্ডে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ প্রাণ হারান মোট ৭৪ জন।
যুদ্ধ ছাড়া এত সেনাকর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ঘটনা নতুনভাবে সামনে এসেছে। বিচারের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন নিহতদের স্বজনরা। আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদকে। তবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময়ই নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল মানুষের মনে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালটা ছিল ভয়ানক
সকাল আটটার দিকে পিলখানায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণে মধ্যে সেখানে পৌঁছে যায় বিভিন্ন টিভির প্রতিবেদক ও রিপোর্টাররা। একুশে টেলিভিশনের তানভির ও আলী আহমেদ রুবেল শুয়ে ভিডিও করছিলেন। সমানে গুলি চলছিল, কিছু গুলি পিলখানার বাইরে এসেও পড়ছিল। তবে সকাল নয়টায় প্রথম সংবাদ প্রকাশ করে একুশে টেলিভিশন। রিপোর্টার সাজেদ রোমেল ও আব্দুল্লাহ তুহিন সেখান থেকে ফোনো লাইভ করে ঘটনা জানাতে থাকেন। তারা লাইভ দেন তখন বিডিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানার উত্তরের গেটের ১ নম্বর গেটের সামনে থেকে। পরে রিপোর্টার সাজেদ রোমেল চলে যান পিলখানার ৫ নম্বর গেটে, হাজারিবাগ প্রান্তে। খুব কাছেই বিডিআর হলরুমে হত্যা তখনো চলছিল। সে সময় সেখানে একুশে টিভি ছাড়া আর কোনো টিভি টিম ছিল না।
সাজেদ রোমেল সামনে গোতে চাইলে বিডিআর সদস্যরা ফাঁকা গুলি করে। পরে হাত উঁচিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন সাজেদ রোমেল। তারা প্রাণখুলে সেনাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ঝাড়েন, মৃত্যু হলেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন বলে দৃঢ় প্রত্যয় জানান। এর মধ্যে সকাল দশটায় বিশেষ বুলেটিনে এসব বক্তব্য প্রচার করা হয়। সেইসঙ্গে ফোনো লাইভ চলে বিডিআর ৫ নম্বর গেট থেকে। এর মধ্যে নিউমার্কেটের দিকে ৩ নম্বর গেটে এসে গেছেন সিনিয়র সাংবাদিক মুন্নি সাহা। তিনি কথা বলেন বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে। সিনিয়রিটি, অভিজ্ঞতা আর মেধা-দক্ষতায় তার প্রতিবেদন বেলা ১১টায় আলোড়ন তোলে সারা দেশে। আগে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের পরেও আড়ালে পড়ে যান সাজেদ রোমেল ও আব্দুল্লাহ তুহিন। এরই মধ্যে ৫৭ সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করে ফেলেছেন বিডিআর সদস্যরা, বিভিন্ন ভবন থেকে স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাটও চলেছে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলায় সাজা হয় অপরাধীদের
সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহীদের আলোচনা শেষে পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি অস্ত্র, গুলি ও গ্রেনেড জমাদানের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়। ঘটনার জেরে আধাসামরিক বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) নাম বদলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়।
হত্যা, লুটপাট ও বিদ্রোহের এ ঘটনায় মোট ৫৮টি মামলা দায়ের করা হয়। হত্যার এক মামলায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৪২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিএনপির প্রয়াত নেতা নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অন্যদিকে বিদ্রোহের জন্য দায়ের করা ৫৭ মামলায় বিডিআরের মোট পাঁচ হাজার ৯২৬ জন সদস্যের বিভিন্ন মেয়াদে (চার মাস থেকে সাত বছর) কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায় প্রদানকারী তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের পর ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার এ রায়টি প্রকাশ করা হয়। রায়ের দৈর্ঘ্য এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ রায়।
মামলায় যে ৮৫০ জনকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয় তাদের বেশিরভাগই বিলুপ্ত ঘোষিত বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআরের সদস্য ছিলেন। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতাও এই মামলার আসামী।
মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আসামিদের কেউ কেউ চিৎকার করে বলতে থাকেন আল্লাহর কাছেই তারা এর বিচার চাইবেন। রায় ঘোষণার পর আদালতে উপস্থিত নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
নিহত সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী মেহেরিন ফেরদৌসী বলেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট কিনা সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্র তার কাজ করেছে। আমাদের এখন দেখতে হবে যে প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পেল কিনা।’
ঘটনায় ৩৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে তদন্ত কমিশন
ঢাকার পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন।
তদন্তের ক্ষেত্রে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি; সামরিক বাহিনী; র্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তি; ডিজিএফআই; এনএসআই; হুকুমদাতা; সামরিক অপারেশনে বাধাদানকারী; সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়; রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা; বিদেশি সংশ্লিষ্টতা এবং একইসঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে কমিশন।
এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান।
নতুন করে এ ঘটনার নানা বিষয় সামনে আসছে
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারও ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আলোচনা সামনে এসেছে। নতুনভাবে সামনে আসছে নানা অভিযোগ আর ষড়যন্ত্রের আলোচনা।
এ ঘটনায় রাজনৈতিক দোষারোপ আগেও হয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অতীতে একাধিকবার এর পেছনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন। একইভাবে শেখ হাসিনাও বারবার আঙুল তুলেছিলেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে।
পিলখানা ঘটনার ১৬ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন পুনরায় তদন্তের দাবি আসছে বিভিন্ন তরফ থেকে। সে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সেনা ও বিডিআর পরিবার তো বটেই, তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদও ভিডিও বার্তায় সেই দাবি তুলেছেন।
সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতে সরকারের সহযোগিতা না করার অভিযোগও করেছেন। যদিও তার বিরুদ্ধেও এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে এসেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল।
সেনাবাহিনী ও তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের পরিবারগুলোর অনেকে ঘটনাটিকে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ বলতে চান না। তাদের মতে পুরো বিষয়টিই ছিল ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আসছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতের নাম।
শেখ হাসিনা-মইন ইউসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভুইয়া বলেন, ‘বাবা-মাকে (নাজনীন আহমেদ) কীভাবে মেরেছে, বলতে আমার বুকটা ফেটে যায়। আমাকে কর্মকর্তারা বলেছিলেন বাবা, তুমি তোমার বাবা-মার লাশ দেখ না, নিতে পারবা না। আমি লাশ দেখতেই পারি নাই। এই নির্মমতা, বর্বরতা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। একটাই অপরাধ ছিল তাদের, তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসত। বাইরের শত্রু থেকে দেশকে রক্ষা করত। বিশ্বাস আছে, বিজয় হবেই।’
নিহত মেজর তামজিদ হায়দার নূরের স্ত্রী তাসনুভা মাহা বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে আমার স্বামীর লাশ পাওয়া যায়নি। চারবার ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে। ১০ মাস পর একজনের লাশ দেওয়া হয়। মিথ্যা কবর দেওয়া হয়েছে। আমি যতবার এর জন্য প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি, আমাকে বলা হয়েছে, আমার স্বামীকে দেশদ্রোহী করা হবে।’
কেকে/এআর